মেঘের দল যখন মেঘদের পেছনে ছুটতে থাকে, আনমনেই প্রশ্নটা উঁকি দেয়। কেন ছুটছে তারা? কিন্তু পরক্ষণেই দিগন্তজোড়া পাহাড়ের সবুজে চোখ পড়তেই জবাবটা পেয়ে যায় চতুর-চঞ্চল বোকা মন। এ বুঝি জীবন্ত কোনো স্থিরতার হাতছানি। কিংবা কোনো সবুজ-রহস্যের উচ্চতার আহবান। যে আহবান আমাদের প্রতিনিয়ত যান্ত্রিকতা ও বাস্তবতার দেয়ালে প্রতিধবনিত হয়ে ফিরে যায় পাহাড়ের দেশে। সেই দেশে যায়নি এমন মানুষ কম-ই আছে। তারপরও সকলে ফিরে যায়।

Sajek Valley


আচ্ছা কেন যায় বারবার ? পাহাড়ের দেশে তো সব পাহাড়ই একই রকম থাকে, তাই না? কে বলল এই কথা?! বৃক্ষের যে পাতাটি এই মাত্র আপনার শরীর বেয়ে ঝরে পড়েছে তার শূন্যস্থান পূরণ দেখতে হলে তো আপনাকে পরবর্তি আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। আজকের সবুজের যে ঘ্রানটি আপনার চিত্তকে বিমোহিত করে তার সাথে আগামীকালের অনুভুতির মিল না ও থাকতে পারে। কিংবা এই মাত্র যেই পাখিটি মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল, আপনি কি নিশ্চিত তার দেখা আপনি আবার কাল এলেও পাবেন? পাহাড় সবসময়ই নতুন, সবুজ সবসময়ই তরুণ, যদি না আপনার মন বুড়িয়ে যায় !


আর তাই তরুন বয়স ও মনের সুযোগ নিয়েই পাড়ি জমালাম চির-চেনা নতুন পাহাড়ী পথে। তিনদিনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম তিনজনে। উদ্দেশ্য খাগড়াছড়ি হয়ে স্বপ্নের সাজেক উপত্যকা! তবে খাগড়াছড়ির একটি দিন ও রাত্রি যাপনের সুখানুভুতি গুলোকে অন্য দিনের জন্য জমিয়ে রেখে এই মূহুর্তে সাজেক ভ্রমনের অনবদ্য ও অভূতপূর্ব অনুভুতি নিয়েই কথা বলবো।

Hills-in-Sajek

খাগড়াছড়ি শহর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তর-পশ্চিমে ও ভারতীয় মিজোরাম সীমান্তবর্তী দূর্গম সাজেক উপত্যকায় পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ৫/৬ ঘন্টা। উল্লেখ্য, এই উপত্যকা মূলত রাঙ্গামাটি জেলার অন্তর্ভূক্ত। আমাদের বাহন পরিবর্তন ও যাত্রা বিরতি করতে হয়েছে -দীঘিনালা-বাঘাইছড়ি-মাচালং-এই তিনটি স্থানে।


দীঘিনালায় পৌঁছালাম প্রায় ৯.১৫-৯.৩০ টা নাগাদ। এইখানে এসে পরবর্তী গাড়ি ও আমাদের অন্য এক সফরসংগীর জন্য অপেক্ষার ফাঁকে সকালের নাস্তাটি সেরে নিলাম। এই অপেক্ষা পুর্বপরিকল্পিতই ছিল, তাই সকালে হোটেল রুম থেকে বের হয়েই কালক্ষেপন না করে সরাসরি বাসে উঠেছিলাম। নতুন সংগী এলে আমরা আবার যাত্রা শুরু করি বাঘাইছড়ির উদ্দেশ্যে । দীঘিনালার পর থেকে চলাচলের জন্য যাত্রী পরিবহনকারী প্রচলিত বাসের বালাই নেই। কারন এর পর থেকে যত সামনে যাওয়া যাবে পথ ততই বন্ধুর হবে।

Road-to-Sajek,-Khagrachari
Road-to-Sajek

তাই চলাচলের জন্য একমাত্র উপযোগী ও নির্ভরযোগ্য বাহন হল চাঁদের গাড়ি খ্যাত একধরনের জীপ এবং মোটরসাইকেল। ঘন্টা দেড়েকের এই পথটি ধরে যতই এগুচ্ছিলাম ততই একটি ভাবনাই বারবার মনে এসেছিল – কেমন হবে স্বপ্নের সাজেক ? জনমানব শূন্য, দূর্গম, নির্জন ইত্যাদি অনেক বিশেষণ-ই ইতিপূর্বে শুনেছি। আর তাই চাঁদের গাড়িতে বসে যখন দু’পাশের ঘন সবুজদের অতিক্রম করছিলাম আনমনেই সাজেক-কে নানান রূপ দিচ্ছিলাম।

uneven-Road-to-Sajek

যতই গভীরে যাচ্ছিলাম মানুষের ঘনত্ব ও নৃ-তাত্ত্বিক পরিবর্তনটা টের পাচ্ছিলাম। অবশেষে ,এসে পৌঁছলাম বাঘাইছড়িতে। উল্লেখ্য, আমরা দীঘিনালা থেকে বাঘাইছড়িতে আসার পথেই খাগড়াছড়ি ছেড়ে রাঙ্গামাটিতে পড়েছি। অর্থ্যাৎ বাঘাইছড়ি রাঙ্গামাটি জেলায় এবং আমাদের পরবর্তি যাত্রাও। বাঘাইছড়িতেই যেখানটায় জ়ীপ থেকে নামলাম, তার পাশেই একটি নদী বয়ে গেছে। যাত্রা বিরতির জন্য খুবই উপযোগী নদীটার পাশে সময় কাটালাম কিছুক্ষন ।


আবার চাঁদের গাড়িতে চড়ে বসলাম মাচালং এর গন্ত্যব্যে। তবে এইবার উঠলাম ছাদে। হ্যাঁ, চাঁদের গাড়ীর ছাদে। অনভ্যস্থতার কারনে প্রাথমিক ভয়টুকু কেটে যেতেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম প্রকৃতির কোলে। পাহাড়ি হাওয়ার প্রতিটি ঝাপটায় কপালের উপর আছড়ে পড়া চুল গুলো সরানোর অবসরে নতুন একটি দৃশ্যের অবতারনা ছিল বেশ উপভোগ্য। মাচালং বাজারের দৃশ্যপট ছিল একটু অন্যরকম। বাজার জুড়ে যেন উৎসবের খেলা চলছে। আদীবাসীরা তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। হাতে বুনা কাপড়,পাহাড়ি রোদ-বৃষ্টিতে ফলানো ফসল। জীবন যাপনের এ এক অদ্ভূত তৃপ্তি,অদ্ভূত অনুভূতি। তবে একটু বেমানান হলেও সত্য, পাহাড়ের এত গভীরেও ব্যবসায়িক আধিপত্য আদিবাসীদের চেয়ে বাঙ্গালীদেরই বেশী।

Machalong Bazar, Sajek, Rangamati
Machalong Bazar, Sajek, Rangamati

বৃহষ্পতি-শুক্র এই দুই বাজারের দিনে এই স্থান থাকে লোকারণ্যে। সাজেকবাসীর সপ্তাহের বাজার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি চাহিদা মে্টাতেই এর আয়োজন। তবে সাত দিনের প্রয়োজন দুই দিনেই কিভাবে মেটায় তার উত্তরটা মেলাতে পারিনি। বলে রাখা ভালো, সাজেক যাওয়ার গাড়িগুলো ও ঐ দুই দিন-ই যাতায়াত করে। অর্থ্যাৎ,সাজেক বাসীর এই অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্যে দুটি দিনের অপেক্ষা করতে হয়। সাজেক গামী অন্য বাহন মোটরসাইকেল সাতদিন-ই চললেও চাঁদের গাড়ির চেয়ে চার গুন বেশি ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য ক’জনের আছে সে প্রশ্ন উঁকি দেয়।

মাচালং থেকে আবার নতুন গাড়িতে চড়লাম। চাঁদের গাড়ির নাক সাজেক অভিমুখী রওনা হতেই দেহের রক্ত প্রবাহে যেন তড়িৎ শিহরন খেলে গেল। যথারীতি ছাদেই বসলাম। গাড়ির কোথাও তিল ধারনের জায়গা নেই। মজার ব্যপার হলো,পুরো গাড়ীতে আমরা শুধু দুজনই ছিলাম বাঙ্গালী। আমার পাশের যাত্রীটি ছিল নৃ-তাত্ত্বিকভাবে সাঁওতাল। এক কথা,দু কথায় জানতে পারলাম, নিজের ফলানো ফসল বাজারে বিক্রি করতে গিয়েছিলেন তিনি। আমাদের ঠিক সামনেই কোলে বসে থাকা শিশুটির চোখ দুটি এখনো স্মৃতিতে রয়ে গেছে। পাশের বৃদ্ধ মানুষটির সহযোগিতার হাসি আজো মনে পড়ে ।

Child-in-Sajek


চাঁদের গাড়ির ক্ষমতা সম্পর্কে নতুন ধারণায় আমাকে অবাক হতে হলো। এতটুকু একটি গাড়ি প্রায় চল্লিশ জন যাত্রী নিয়ে এগিয়ে চলছে উচু-নিচু আঁকা-বাঁকা ইট বিছানো পথ বেয়ে। কোথাও কোথাও রাস্তার ঢাল এতটাই খাড়া যে,ঢালু বেয়ে ওঠার সময় মনে হয় ঐ পাশে গভীর কোনো খাদ থাকা খুবই সম্ভব। শরীর গুলো সব একই সাথে দোল খাচ্ছে, ডানে ,বামে, গাড়ির তালে।

পাহাড়ে গেলে যে কেউর-ই চোখ অজান্তেই খুঁজতে থাকে সব চেয়ে উঁচু চূড়াটি। ব্যতিক্রম ছিলাম না আমরাও। দৃষ্টি সীমানা দূরে পাঠিয়ে দিলাম সবচেয়ে চূড়ার খোঁজে। এই তো পেয়েছি, এটাই সব চেয়ে উঁচু । গাড়ি অন্য দিকে ঘুরতেই সবুজের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আরেকটি উচ্চতা। না না এই তো, নিশ্চিত এটিই হবে সবচেয়ে উঁচু।এই ভাবে কতবার নিশ্চিত হতে হল,তা হিসেব করা হয়নি।

একটি পাহাড়ের ঢালু বেয়ে চূড়ায় উঠতেই ভীষণভাবে চমকে গেলাম।হঠাৎ যেন নতুন কোনো দেশে এসে পৌছেছি। মেঘদের একোন দিগন্ত জোড়া খেলা! দুরান্তে মেঘের আড়ালে ভারতের সীমান্তবর্তী মিজোরামের ঘন সবুজের কালো পাহাড়!যতই সময় যাচ্ছে প্রকৃতি যেন ক্রমশ রহস্যময় হয়ে উঠছে।নিরব হয়ে আছে,পথিমধ্যে হঠাৎ দু’একজন আদিবাসীর দেখা মেলে।আর ছিল মধ্য দুপুরের রোদগুলোর সাথে মেঘদলের আধিপত্য বিস্তারের খেলা। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি সাজেক দেশে, আমাদের সঙ্গী মিজোরামের পাহাড়গুলোও।


আর কয়েক মিনিট! স্থানীয় সহযাত্রীরা জানালো। পৌছে গেছি প্রায়। বুকের ভেতরটা চঞ্চল থেকে চঞ্চলতম হয়ে উঠেছে। গাড়ি থেমে গেছে গন্তব্যে। বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম মাটিতে পা রেখে। আড়মোড়া ভেংগে সমস্ত রক্ত প্রবাহকে ঝাড়া দিলাম শরীরের ভেতর। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।চোখ বুলা্তে লাগলাম আশেপাশে।সাজেকে প্রধানত মিজো এবং পাংখোয়া আদিবাসীদের বসবাস।একটু পাশেই ছিল বি জি বি ক্যাম্প।সেখানকার এক সৈনিকের সাথে পরিচয় ও আলাপের এক পর্যায়ে তিনি জানালেন-পাংখোয়ারা খুবই ধনী ও অভিজাত।তাদের বেশির ভাগেরই দৈনন্দিন জীবন,শিক্ষা,জীবিকা প্রভৃতি মিজোরাম কেন্দ্রিক।তাঁর মতে-পাংখোয়ারা নিজস্ব ভাষা ছাড়াও ইংরেজী ও হিন্দিতেও দক্ষ এবং বাংলা জানেনা বললেই চলে।

indigenous-home-sajek-rangamati

আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম,সেইখান থেকে মিজোরাম সীমান্তের একটি বাজার দেখা যাচ্ছিল। মেঘ ও রোদের লুকোচুরিতে কখোনো তা হারিয়ে যায়। দিগন্তের পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা মেঘ দেখে মনে হয় এই বুঝি বিশ্রামের অবসর পেল তারা। দমকা বাতাসে যখন আবার মেঘেরা ছু্টে যায়, মনে হয় দূরের কোনো গৃহস্থের রসুইঘরে মস্ত রান্নার আয়োজন চলছে। সামনে শুধু সবুজ আর সবুজ। সেই সাথে সূর্যের আলো যোগ হয়ে তৈরী করেছে সবুজেরও কত রঙ!

আচ্ছা কোনো পাখির কথা বলছিনা কেন? এত দীর্ঘ যাত্রায় একবারও বলিনি তাদের কথা। হ্যাঁ,আমাদের চারজনের কেউই তাদের দেখা পেয়েছি বলে মনে করতে পারছিনা। অগুনিত পাহাড় ও গাছের মাঝেও ছিল না পাখিদের কোলাহল। থাকবে কিভাবে, মানুষের হাত যে সবুজের দেয়াল ভেদ করে পাহাড়ের গভীরে পাখিদের হৃৎপিন্ডে গিয়ে পৌছেছে।


প্রিয়া আর প্রকৃতির সান্নিধ্য সময়কে টেনে নেয় চোখের পলকে। সাজেকের দেশ থেকে আমাদের বিদায়বেলাও ঘনিয়ে এল আচানক । চোখদুটি শেষবারের মত ছোটাছুটি শুরু করে দিল চারিদিকে, যেন যতটুকু পারি নিয়ে যাই এমন অবস্থা। থেকে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছাকে প্রশ্রয় দিতে পারলাম না। আজ যে শুক্রবার…ইতিমধ্যে শেষ চাঁদের গাড়ি মিস্ করে ফেলেছি । মোটরসাইকেল-ই শেষ ভরষা। তা না হলে অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী বৃহস্পতিবার নাগাদ !

—————————————————————————————————————————————————————-

(আপডেটঃ এই লেখা ২০১১ সালের। এখনকার সাজেকের সাথে এর মিল খুব কমই আছে। এখন সাজেক যাওয়ার অনেক গাড়ি, অনেক আয়োজন। সেখানে এখন হরেক রকমের বাতি আছে কিন্তু প্রান নেই, সবুজের ঘ্রাণ নেই। যে আদিবাসী পরিবারগুলো ছিল তারাও এখন নেই। সাজেক তার রুপ হারিয়েছে এবং হারাচ্ছে আমাদের নির্বুদ্ধিতা ও লোভের কাছে।)

—————————————————————————————————————————————————————-

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share63
Tweet
Pin
Share