১৬’র শেষের দিকে ঘুরে এলাম নিঝুমদ্বীপ-হাতিয়া-মনপুরা। আমাদের ৬ জনের দল। সময় নিয়েছি ৬ দিন, ৭ রাত। এর মধ্যে দুই রাত লঞ্চে আসা-যাওয়া। আমাদের ভ্রমন শুরু হয় নিঝুমদ্বীপ থেকে উলটো দিকে। এর আগেই আমরা নিঝুম রিসোর্ট বা অবকাশ রিসোর্টের ঢাকাস্থ অফিস থেকে আমাদের রুম বুকিং করে রাখি। এরপর লঞ্চের বুকিং দিয়ে দিই। নিঝুম দ্বীপে সরাসরি কোনো লঞ্চ নেই। তাই প্রথমে লঞ্চে হাতিয়া পৌঁছাতে হয়েছে। হাতিয়া যাওয়ার বেশ কিছু লঞ্চ থাকলেও আমরা ফারহান-৩ এ বুকিং দিই।
যথারীতি, ২৮ তারিখ বিকেলে ঢাকা সদরঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে দিল। বাই দ্যা ওয়ে, আমরা কিন্তু লঞ্চ মিস করিনাই। 😉 সাতারে অজ্ঞতার করনে পানি ভীতি কাজ করে কিন্তু ঘোরাঘুরির নেশায় তা সবসময় মনে থাকেনা।যদিও মাঝ দরিয়ায় গেলে আবার নেশা কাইটা যায়। 😛 যাইহোক, যেহেতু শীতকাল তাই নদী বা সমুদ্র সবই ঠান্ডা, মনকে এই বুঝ দিয়া ঠান্ডা রাখসিলাম। জার্নিটা ছিল আসলেই উপভোগ্য। বহুদূরে মাছ ধরার ছোট ছোট নৌকা বা ট্রলারে মিটিমিটি বাতি গুলো দেখতে ভালো লাগে। বাস্তবতা হল, শীত, বৃষ্টি যাই হোক না কেন, ঐ টিমটিমে বাতিই নিয়ে তাদের রাত তথা জীবন পার করতে হয়। আপনি যতই সামনে যাবেন ততই সংগ্রামী এক জনপদের দেখা পাবেন যাদের জীবন একটি নৌকা আর বিশাল জলরাশি দ্বারা পরিবেষ্টিত।
এর আগে বরিশাল, চাঁদপুর ইত্যাদি অনেক জায়গায় যাওয়ার সুবাদে বিভিন্ন লঞ্চঘাট আমরা অনেকেই কম-বেশি দেখেছি। কিন্তু আমার এই যাত্রায় আমি এমন কিছু লঞ্চঘাট দেখেছি যেখানে কোনো “ডক” নেই! লঞ্চটি এমন একটি পাড়ে এসে ভিড়ল যার একটু সামনেই কিছু ঘর-বাড়ি। দেখে মনে হবে সাধারন একটি নৌকার মাঝি তার বাড়ির কাছে নৌকা ভিড়িয়েছে। আমি অনুমান করার চেষ্টা করলাম যে নদীর পাড়ে সরাসরি একটি লঞ্চ ভীড়তে পারে তাহলে সেই পাড়ের গভীরতা কেমন হতে পারে! একটি কাঠের পাটাতন দিয়ে মানুষ পাড় থেকে সরাসরি লঞ্চে উঠছে ও নামছে।
হাতিয়া যাওয়ার পথে এই লঞ্চ বেশ কয়েকটি যায়গায় থামলেও চাঁদপুর থামেনা। কিন্তু অন্যান্য ঘাটে থামানো ও মালপত্র ওঠানো-নামানোতে বেশ ভাল সময় যায়। আমরা যখন মনপুরা পৌছলাম তখন রাত পেরিয়ে সকাল।ঢাকা থেকে আনা অনেক মালপত্র মনপুরায় নামানো হয় তাই মনপুরায় বেশকিছু সময় যাত্রাবিরতি হয়। যেহেতু আমাদের প্রাথমিক গন্তব্য হাতিয়া তাই আমরা লঞ্চ থেকেই যতটুকু পারা যায় মনপুরায় নজর বুলিয়ে নিলাম এবং প্রথম দর্শনে ভালই লেগেছে। মনপুরা থেকে হাতিয়া যেতে আরো ৪০-৪৫ মিনিট লাগলো।
এবার হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার পালা। বিভিন্ন মাধ্যম বা ভ্রমন অভিজ্ঞতা থেকে আগেই জেনেছিলাম যে, হাতিয়া থেকে নিঝুম দ্বীপ যেতে হলে আগে মোটর সাইকেল বা ট্যাক্সি নিয়ে মোক্তারিয়া ঘাট যেতে হবে। তো, ট্যাক্সি ভাড়া জানতে চাইলে একজন জনিয়ে দিল কোনো ভাবেই ৭০০ টাকার নিচে সম্ভব নয়। মোটরসাইকেলে গেলে খরচ আরো বেশী পড়বে তা সহজেই অনুমেয়। আমরা ছয়জন, সাথে ব্যাগ। দুই ট্যাক্সিতে ১৪০০ টাকা। এমন সময় একটি গুরুত্বপূর্ন তথ্য নিয়ে এল একজন রিকশাচালক। উনি জানালেন, বেকেরবাজার থেকে মোক্তারিয়া ঘাট পর্যন্ত লোকাল জীপ পাওয়া যায়। ভাড়া জনপ্রতি ৭০ টাকা। বাহ! আর কি চাই? তো বেকেরবাজার কিভাবে যাব? রিকশায়, ভাড়া ৪০ টাকা, জবাব দিলেন তিনি। উনার রিকশায় বেকের বাজার পৌছাতে সময় লাগলো বড়জোর ১০ মিনিট। ভাড়া যে মোটেই ৪০ টাকা নয় তা আমরা বুঝতে পারলাম। কিন্তু উনার দেখানো নতুন পথে আমাদের যে অনেক টাকা সাশ্রয় হল তা ভেবে অতিরিক্ত ভাড়ার কথা ভুলে গেলাম।
বেকের বাজার পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরে একটি জীপ এল। মানুষ বোঝাই, কিন্তু তারপরও উঠে পড়লাম। কিছুপথ যেতেই মানুষ নামল, আবার উঠল, এইভাবেই সারা পথ গেলো। বুঝলাম এইপথের এইবাহন অলটাইম হাউসফুল থাকে। তবে খুব বেশী যে গিঞ্জী ব্যাপারটা এমন না।মোটামুটি আরাম করে বসা যায়। কিন্তু রাস্তার যে দশা তাতে মনে হয় ট্যাক্সি নিলেও খুব আরামদায়ক হত না। রাস্তা কিছু দূর ভাল, তো কিছুপথ ভাঙ্গা এবং শেষে দিকটায় একটু বেশিই খারাপ মনে হল। প্রায় ২ ঘন্টার বেশি সময় পর আমরা মোক্তারিয়া ঘাট পৌঁছালাম। ঘাটের ঐপারেই নিঝুমদ্বীপ!
নৌকাযোগে ঐ পারে যেতেই, আরেক অভিজ্ঞতা হল। মোটরসাইকেল এবং রিকশাচালকদের সামলানো যে আমাদের এই ট্যুরের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে তা আমরা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলাম ঐপারে গিয়েই। এবং পরবর্তীতে আমাদের ধারনাই সত্যি হল। ট্যুরের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এর মুখোমুখি হতে হয়েছে অনেক বার।যাই হোক, নৌকা যখন আমাদের নিঝুমদ্বীপে নামিয়ে দিল একদল মোটরসাইকেল চালক এল। আমাদের উদ্দ্যেশ্য নামার বাজার। ঐখানেই আমাদের রিসোর্ট।ভাড়া জিজ্ঞেস করতেই, প্রথমে একজন মোটরসাইকেল চালক বলল ১২০ টাকা, দুইজন করে । অন্যদিকে এক রিকশাচালক এসে বলল এক রিকশা ১০০ টাকা, দুজন করে। ইতিমধ্যে মোটরসাইকেল ১০০ টাকায় রাজি হয়ে গেল। এইশুনে অন্য রিকশা চালক মোটরসাইকেলে গেলে এক্সিডেন্ট হবে বলে আমাদের ভয় ধরানোর চেষ্টা করল। বুঝেন অবস্থা। যাইহোক, সময় কম লাগবে ভেবে আমরা মোটরসাইকেলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঘটনা এখানেই শেষ না। এরপর যা শুরু হল তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না।
আমরা মোটরসাইকেলে চড়ে বসতে যাব এমন সময়, আরো ২/১ জন মোটরসাইকেল চালক এসে বলল তাদের মোটরসাইকেলে যেতে। একথা শুনেই আমাদের মোটরসাইকেল চালক প্রতিবাদ শুরু করল। প্রতিবাদ একসময় তাদের মধ্যে ঝগড়া-আক্রমনাত্মক কথায় রুপ নিল । তারপরো আমরা উঠে বসলাম। এরপর শুরু হল সিনেমা। একজন মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের রাস্তায় বেরিকেড দিয়ে দাড়াল। বলল, যেতে হলে তাকে মেরে যেতে হবে। আমরা আর দেরি করলাম না। নেমে পড়লাম। ব্যাপারটা গুরুতর হয়ে যাচ্ছে দেখে আমরা ঠিক করলাম কোনো মোটরসাইকেলেই যাবনা। রিকশায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ততক্ষনে রিকশাচালকরা পল্টি নিয়ে নিসে। ভাড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকা। তখন অত কিছু ভাবার সময় আর নেই। ১২০ টাকাই সই।
রিসোর্টে এসে নিজেদের রুম বুঝে নিলাম। পেছনের পুকুরে গোসল দিলাম।পুকুরের চারপাশে অনেক গাছ, আর সে গাছে টিঁয়া পাখির বাসা। ঝাঁক বেধে টিঁয়া পাখিদের উড়ে যেতে দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। ইতিমধ্যে একজন লোক হাজির। কি চাই?-জানতে চাইলাম। জানতে চাইল, দুপুরে কি দিয়ে খাব? আমরা একটু অবাক হলাম। কারন আমরা জানতাম, রিসোর্টে কোনো খাবার ব্যবস্থা নাই।পরে কথা বলে বুঝতে পারলাম ইনি পাশের এক হোটেলের মালিক। আমাদের রিসোর্টে ঢুকতে দেখে নিজেই চলে এসেছেন, অর্ডার কনফার্ম করতে। এই যাত্রায় আমাদের এই জিনিষটির মুখোমুখি বেশি হতে হয়েছে। মানে, আমরা কই যাব, কিভাবে যাব, কি খাব তা যেন আমরা স্বাধীন ভাবে করতে পারছিলাম না। সবসময়ই কেউ না কেউ এসে প্ররোচনা বা অনাকাঙ্খিত উপদেশ দেয়ার চেষ্টা করছে। হয়তো আমরা বসে বা দাঁড়িয়ে কথা বলছি এমন সময় কেউ একজন এসে আমাদের কথা শোনা শুরু করল যাকে আমরা কেউই চিনি না।
দুপুরে খেয়ে নিলাম। নানা রকম মাছ দিয়ে। এরপর চৌধুরিখাল যাব বলে ঠিক করলাম।ঐখানে নাকি হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। নৌকা ভাড়া করলাম ১১০০ টাকা দিয়ে। সৌভাগ্যক্রমে আমরা আরেকটা ৫ জনের দল পেয়ে গেলাম। তাই নৌকার খরচ মোটামুটি নাগালের মধ্যেই রাখা গেছে। নৌকা ভাড়ার সময় আপনি যত বেশি দরাদরি বা ম্যানেজ করতে পারবেন আপনি ততই নিজেকে বাঁচাতে পারবেন। ওরা নৌকা ভাড়া প্রথমে ২০০০ টাকা চেয়েছিল, এরপর, ১৫০০ টাকা। পরে আমরা ১১০০ টাকাতে নিমরাজি করাতে পেরেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, যেতে কতক্ষন লাগে? বলল, আপ-ডাউন ১ ঘন্টা। পরে বুঝলাম কথা সত্য না। ভাড়ার ন্যায্যতা প্রমানের জন্য এই উত্তর দেয়া হয়েছিল। নৌকায় চড়ে বসলাম। যাওয়ার পথের নদীর দুপাশের দৃশ্য সত্যি খুব উপভোগ্য ছিল। নানান রকম পাখি মাছ ধরায় ব্যস্ত। রাজহাঁসের একটি দল পানিতে অলস ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাখাল তার মহিষের পাল নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। নদীতে ছোট ছোট মাছের সে কি ছোটাছুটি, লাফালাফি! ছোটছোট মাছের পোনা গুলো যখন ঝাঁক বেধে ঝাপ দিচ্ছিলো, সূর্যের কিরনে সেগুলোকে ক্ষণিকের জন্য অদ্ভুদ রুপালি দেখাচ্ছিল!
নৌকা চেপে রিসোর্টে ফিরে আসলাম। সন্ধ্যায় আড্ডা, গল্প, রাতে হাঁসের মাংস দিয়ে খাওয়া শেষে রিসোর্টে ফিরলাম। সকালে ছোঁয়াখালি যাওয়ার প্লান করলাম। ওইখানেও নাকি হরিণ দেখা যায়। তবে যেতে হবে খুব সকালে এবং মোটর সাইকেলে। প্রতি মোটরসাইকেল ১০০ টাকা, দুইজন। রিসোর্টের কেয়ারটেকার আমাদের সাথে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল গাইড হিসেবে। যাই হোক, সকাল ৬ টায় উঠে রওনা দিলাম। মটরসাইকেলে পৌঁছাতে ১৫/২০ মিনিটের বেশি সময় লাগলোনা।চারিদিকে তখন ভীষণ কুয়াশা। কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখলাম, একপাল হরিণ দৌড়ে পালালো। অতটুকুই! তারপরো আরো কিছুক্ষন এদিক-সেদিক চেষ্টা করলাম। লাভ হলনা। ইতিমধ্যে সূর্য উঠে গেল।
আমরা ফিরে এলাম। সকালের নাস্তা সারলাম। পরবর্তী প্ল্যান ভার্জিন আইল্যান্ড খ্যাত “দমার চর”।ট্রলার ভাড়া কত? এখানেও আগের হিসাব।যতবেশি দক্ষতার সাথে দর কষাকষি করা যায়। আগেই খবর নিয়ে জানলাম ট্রলার ভাড়া ৪০০০/৪৫০০ চাইবে কিন্তু বাস্তবে ২৫০০, এমনকি ২০০০ ও যাওয়া যায়। যাই হোক আমরা ৩০০০ এর কমে আনতে পারিনি। রওনা দিলাম দমার চর। যাওয়ার পথে আরো অনেক ছোট-বড় চর দেখা যায়। কোনটিতে মহিষের পাল চরে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে সাদা বক, সারস, কিংবা নানান পাখি নিজেদের মত করে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। পথিমধ্যে একটি চরে যাত্রা বিরতি হল। একটি দোকান পাওয়া গেল। চা নাস্তার ফাঁকে দোকানি জানাল সে মূলত কাঁকড়া ব্যাবসায়ী। দেশের বাইরেও তার কাঁকড়া রপ্তানী হয়। আমাদের কয়েকজন ১০ টাকা দরে কিছু কাঁকড়া কিনেও নিল। প্রায় সোয়া ১ ঘন্টা পর আমরা দমার চর পৌছালাম। পৌঁছে ভালই লাগল। একপাশে মহিষের বড় একটি পাল দেখা গেল। শীতের পাখিরা ইতিউতি ছোটাছুটি করছে। এছাড়া না্নান রকম পাখি্র আসা-যাওয়াতো রয়েছেই। ইতিমধ্যে জ়োয়ার শুরু হয়েছে। ফেরার পালা। দমার চরে যাওয়া এবং ফিরে আসার রাস্তা ভিন্ন। এর ফলে পুরো নিঝুম দ্বীপ ঘোরা হয়ে যায়। আমাদের এই রকমই বলা হলেও হলে বাস্তবে তা হল না। যে পথে এসেছি ঐ পথেই ফিরে আসলাম। কারন হিসেবে জোয়ার-ভাটার অংক বোঝানো হল।
এবার ফেরার পালা। রিসোর্টে ফিরে বারবিকিউ আয়োজন করলাম। বাজার থেকে প্রয়োজনীয় সদাই কিনে নিজেরাই সব করলাম। শেষ হতে হতে রাত প্রায় ১২/১ টা। সারাদিনের ক্লান্তি আর পরের দিনের শিডিউল নিয়ে বিছানায় গেলাম।
পরদিনের গন্তব্য হাতিয়া হয়ে মনপুরা। সেই গল্প অন্যদিন। আজ বোধ একটু বেশীই হল।