বিমান কখন ল্যাণ্ড করবে সেই অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ পাইলট ঘোষণা করলেন যে আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন। কিছুক্ষণের মধ্যে যদি কুয়াশা সরে না যায় তাহলে ঢাকা ফেরত যেতে হবে। শুনে আমরা দমে গেলাম। যদি তাই হয় তাহলে সকল টাইমিং এবং প্ল্যানিং ভেস্তে যাবে। সিটে গা এলিয়ে বসে রইলাম। মাথায় নানা রকম চিন্তা খেলে যাচ্ছিল। কিছুক্ষন পর আবারো পাইলটের কন্ঠ ভেসে এল। এইবার অবশ্য সুসংবাদ। আমাদের ঢাকা ফেরত আসতে হবে না। কাঠমান্ডুতেই নামবো।

হিমালয় কন্যা নেপাল! পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রচুর পর্যটক আসে এই হিমালয়ের টানে। আমরাও ব্যাতিক্রম ছিলাম না। যাত্রা পথে বিমানে বসে যখন হিমালয়ের সারিবদ্ধ পর্বতশ্রেনী দেখা যায় তখন সেই পিপাসা যেন আরো কয়েকগুন বেড়ে যায়। আর মনে এক প্রশ্ন জাগে, হিমালয় কেমন হবে আরো কাছ থেকে দেখতে?

সেই প্রশ্নের উত্তর অনেক ভাবেই পাওয়া সম্ভব। যদি পকেট গরম থাকে তাহলে হ্যালিকপ্টার ভাড়া করে চলে যেতে পারেন ঠান্ডা হিমালয়ের একেবারে কাছে। এমনকি মিনিট বিশেকের জন্য পা রাখার সুযোগও পাবেন। পক্ষান্তরে, আপনার যদি পকেট ঠাণ্ডা থাকে আর রক্ত গরম থাকে তাহলে হাইকিং করেও কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাবেন। আমাদের ঐ উপরের কোনটিই ছিলনা। তাই, আমরা প্রচলিত এবং সহজ পথেই এগিয়েছি।

আমাদের লক্ষ্য ছিল, কাঠমান্ডু এবং পোখারা। সাত দিনের ভ্রমন প্ল্যান এবং বাংলাদেশ বিমানের টিকিট আগেই করে রাখা ছিল। বিমান থেকে নেমেই চলে গেলাম ইমিগ্রিশানে। নেপাল বাংলাদেশীদের অন এরাইভ্যাল ভিসা দেয়। প্রথমবার এই ভিসা ফ্রী। আমরা ভিসা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

আমাদের গন্তব্য থামেল, যা মুলত কাঠমান্ডুর ট্যুরিষ্ট এলাকা। এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই অনেক ট্যাক্সি দেখা গেল। একটা ট্যাক্সি নিয়ে থামেলের উদ্দ্যেশে রওনা দিলাম।যে কোন ভ্রমনে অনলাইনে হোটেল বুকিং না দিয়ে নিজে রুম দেখে নেয়া আমি ভাল মনে করি। হোটেল নানা থামেল নামে একটা হোটেলের রিকমেন্ডেশন আমরা আগেই পেয়েছিলাম।সেখানে চলে গেলাম। রুম দেখে উঠে পড়লাম। ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যা। এরপর বের হলাম হাঁটাহাঁটি এবং চারিপাশ দর্শনে।

থামেল পুরোপুরি জমজমাট এলাকা। রাস্তার দুপাশে লাইন ধরে বাহারি রকমের দোকান, রেষ্টুরেন্ট, পাব, নাইটক্লাব ইত্যাদি। থামেলের পথে হাঁটার সময় কানে আসে নানা রকমের মিউজিক। কখনো কোন ডিসকো বার থেকে উচ্চ শব্দ আসছে, কখনো ফেরিওয়ালারা ছোট বেহালা বাজিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, কখনো বা কোন এক রেষ্টুরেন্টে চলতে থাকা লাইভ মিউজিক শো’র শব্দ শোনা যাচ্ছে। এই বাহারি মিউজিক যখন আমাদের কানে বাজছে ঠিক তখনই মস্তিষ্কের ব্যাকগ্রাউণ্ডে চলছে আসছে দিনগুলো নিয়ে ভাবনা।

ভাবতে ভাবতে এবং হাঁটতে হাঁটতে খাওয়ার সময় হয়ে গেল। ট্যুরিস্ট এলাকা হওয়ায় থামেলে সকল খাবারের রেষ্টুরেন্টেই কম-বেশী আগুন লেগে থাকে। অবশ্য সেটা অর্থনৈতিক আগুন। সেই আগুন থেকে বাঁচতে আমরা হোটেল আল মদিনা চলে গেলাম। সহনশীল খরচে খাওয়া-দাওয়ার জন্য এই হোটেল ভাল অপশন হতে পারে। খাওয়া পর্ব শেষে হোটেল রুমে ফিরে আসলাম। এবার ঘুমানোর পালা।

কিন্তু না। ঘুমানো এত সহজ হলো না। আমাদের হোটেলের আশেপাশেই কোন এক নাইট ক্লাব ছিল। রাত ৩টা পর্যন্ত অনিচ্ছাকৃত গান-বাজনা শোনার পর চোখে ঘুম এল। কিন্তু বেশীক্ষণ তা স্থায়ী হল না। কারণ পরের দিন সকালে পোখারা যাওয়ার বাস ধরতে হবে। তাই সকাল সাতটার মধ্যেই বাস পার্কে চলে যেতে হয়েছে।

এই বাসের টিকেট আমরা হোটেলেই বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। অনেক গুলো বাস কোম্পানী আছে যারা পোখারা যায়। আমরা একটা বাসের ডান পাশের সিট বুকিং দিলাম। অফিসিয়ালি ওটা “রিভার সাইড” নামে পরিচিত। যাত্রাপথের যত আনন্দ ও সৌন্দর্য ওপাশেই।

থামেলে যতটুকু সময় ছিলাম তার মধ্যে আমরা অনেকবারই পোখারার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনেছি। তাই আমাদের অগোচরেই পোখারার সৌন্দর্য দেখার একধরনের চাহিদা তৈরী হয়ে গিয়েছিল। বলে রাখা ভালো যে, পোখারা থেকে হিমালয়ের যে অংশটি দেখা যায় তার নাম অন্নপূর্ণা রেঞ্জ। আমরা নির্দিষ্ট সময়ে বাসে চড়ে বসলাম। কিছুদূর যাওয়ার পরই টের পেলাম যে রিভার সাইডের সিটের চাহিদা কেন এত বেশী। যদিও তখনো কোন নদীর দেখা আমরা পাইনি। আমাদের বাস পাহাড়ী ঢাল বেয়ে যখন উঁচু উঁচু পাহাড়ী পথ ধরে যাচ্ছিল সূর্য কিরন যেন পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে খেলা করছিল। কোন এক উঁচু পথে যাওয়ার সময় বাইরে তাকালে অনেক নিচে রাস্তা দেখা যায়, যেই রাস্তা ধরে আমরা উঠে এসেছি। আবার অনেক দূরে আরো একটি রাস্তা চোখে পড়ে, যেই রাস্তায় আমরা কিছুক্ষনের মধ্যে উঠতে যাচ্ছি। এই ধারাবাহিকতা যেন আমাদের সমুদ্রপৃষ্ট থেকে চৌদ্দশত মিটার উপরে উঠার প্রতিটি ধাপ এক এক করে উপভোগ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। যেহেতু সময়টার শীতের তাই কুয়াশারা চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিল। ফলে অনেক দূরে স্পষ্ট দেখা না গেলেও পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সূর্য রশ্মির অকারন লুকোচুরি যে রহস্যের সৃষ্টি করেছে তার দিকে তাকিয়ে অবলীলায় সময় কাটিয়ে দেয়া যায়।

Way to Pokhara

সকালে রোদ আর পাহাড়ের দৌরাত্ম্যে হঠাৎ এসে যোগ দিল একটি নদী। নাম ত্রিশুলি। পোখারা যাত্রা পথের প্রায় পুরোটা জুড়ে সঙ্গী হয়ে ছিল পাথুরে এই নদী। পাহাড়ী ঢালে গড়িয়ে পড়া এই নদীর গতিপথে হঠাৎ হঠাৎ মাথা উঁচু করে রাখে কিছু পাথর। আর সেই পাথর কেটে চলা নদীর স্রোত যে গুচ্ছ গুচ্ছ ফেনিল রঙ সৃষ্টি করে তা উপভোগ করতে খুব একটা রসিক মন লাগেনা।

trishuli river nepal

পথ চলতে চলতে চোখে ঘুম আসি আসি করছে। অনেকটা উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি নিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ দিগন্তে সাদা কিছু একটা চোখে পড়ল। চকিতেই সোজা হয়ে বসলাম। না, মেঘ না। হিমালয় ওটা! ঘুম উবে গেল। গাছাপালা,পাহাড়,ঘরবাড়ি ইত্যাদি সবকিছু ছাড়িয়ে মাথা উঁচু করে রেখেছে ওটা। বুঝলাম আমরা পোখারায় চলে এসেছি প্রায়। অবশেষে পাহাড়, নদী, হিমালয় দেখতে দেখতে এবং মাঝখানে ২টি টয়লেট ব্রেক ও একটি লাঞ্চ ব্রেক সহ দুপুর তিনটায় আমরা পোখারা পৌছালাম।

বাস থেকেই নামতেই হোটেলের দালাল পেয়ে বসলো। প্রথমে পাশ কাটতে চাইলাম। কিন্তু নাছোড়বান্দা ছাড়তে চাইলো না। পরে কন্ডিশন দিলাম, নিজের বাজেট বললাম, সেই চুক্তিতে ট্যাক্সিতে চেপে বসলাম।

যথারীতি হোটেলে পৌছে গেলাম। হোটেল লেইক সাইডেই। লেক সাইড হল পোখারার ট্যুরিষ্ট এলাকা। রুম দেখলাম। ৪ তলায়। বারান্দা আছে। আর বারান্দা থেকে সরাসরি হিমালয় দেখা যায়! ভাড়া? বলল, ১০০০ রুপি। আমিতো ভেতরে ভেতরে মহা খুশি। এই দামে মাউন্টেন ভিউ পাবো ভাবিনি। যাই হোক, উঠে গেলাম রুমে। লাগোয়া বারান্দায় গেলাম। বিকেলের সূর্য ততক্ষনে বিদায়ী রঙ ধারন করেছে। তারই আলো পড়ে দেখার মত রূপ নিয়েছে হিমালয়।

The Himalaya from the pokhara

প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। লেইকের ধারে গেলাম। এইদিক সেইদিক হাঁটাহাঁটি করলাম। পোখারা শান্ত শহর। এখানে থামেলের মত চাকচিক্য বা জৌলুশ নেই কিন্তু প্রশান্তি আছে, যান্ত্রিকতা থেকে ছুটি পাওয়ার ফুসরত আছে। বস্তুত, নেপালে পর্যটনের মূল আকর্ষন রাফটিং প্যরাগ্লাইডিং, বাঞ্জি জাম্প এবং হিমালয়ের কাছে ঘেঁষা সহ যাবতীয় কর্মকান্ডের শুরু এই পোখারা থেকেই।

রাতে খেয়ে রুমে চলে আসলাম। পরের দিনের প্ল্যান পোখারার দর্শনীয় স্থানগুলো দেখা। এর অফিসিয়াল নাম “সাইট সিয়িং”। এটা দুইভাবে করা যায়। একটি হল ট্যাক্সি ভাড়া করে। এতে খরচ বেশী পড়বে। আর দ্বিতীয়টি হল, ট্যুরিষ্ট বাসে সিট বুকিং করে। আমরা ট্যুরিষ্ট বাস বুক করলাম।ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বিছানায় গেলাম।

পরের দিন, বাস আমাদের সকালে হোটেলের সামনে থেকে তুলে নিল। প্রথমে বিন্দুবাসিনী মন্দির, ব্যাট কেইভ, গুপ্তেশ্বর মন্দির, দেভি’স ফলস সহ কয়েকটি স্পট দেখানো হল। উল্লেখ্য, ট্যুরিষ্ট বাস বুক করার ক্ষেত্রে বাসের সিটের ব্যাপারে কথা বলে নেয়া ভাল। কারণ আমাদের সাথে এক পরিবার উঠেছে যাদের বাসের বনেটে বসতে হয়েছে। যদিও তারা এ নিয়ে অনেক বাক-বিতন্ডা করেছে। কিন্তু ততক্ষনে দেরী হয়ে গেছে। যাই হোক, ঘুরাঘুরি শেষে বিকেলে আবার হোটেলে নামিয়ে দিল।

হোটেলে আসলাম। আগের রুমের কিছু সমস্যা ছিল। তাই নতুন রুম বুঝে নিলাম। এইবার সব চেক করে নিলাম। বোনাস হিসেবে হিমালয় মুখি জানালা পেলাম! জানালা দিয়ে তাকালেই সদা উঁচু হয়ে থাকা অন্নাপূর্ণার মাথাগুলো দেখা যায়। ফ্রেশ হয়ে কাউন্টারে গেলাম পেন্ডিং বিল ক্লিয়ার করতে। কাউন্টারে গিয়ে যা হল তার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। রুম ভাড়া ১০০০ রুপি ঠিকই আছে তবে সেটা নাকি ইন্ডিয়ান রুপি (IC) , নেপালী (NC) নয়! তার মানে রুম ভাড়া দাঁড়ায় ১৬০০ রুপিতে। কারণ জিজ্ঞেস করাতে ম্যনেজার বলল, আমাদের দেখে তারা ইন্ডিয়ান মনে করেছে তাই ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে বলেছে। নেপালে আসার পর থেকেই খেয়াল করলাম যে কোন কিছুর দাম বলার ২/৩ সেকেন্ড পর তারা বলে উঠে “নেপালী”। এখন আমি বুজতে পারলাম এর কারণ কি।

এই দিকে হোটেল ম্যানাজারের কথা শুনে মেজাজ হয়ে গেল খারাপ। কিন্তু রাগ দেখালাম না। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং দর কষাকষি করে ১৩০০ নেপালি রুপিতে ফিক্স করলাম। বাজেটের মধ্যে থাকায় আর পছন্দের রুম হওয়ায় কথা বাড়ালাম না। ঐ সন্ধ্যাটা লেইক পাড় ও আশেপাশের ট্যুরিষ্ট শপে ঘুরাঘুরি করে কাটিয়ে দিলাম।

Phewa Lake, Kathmandu

এরপর মাড়ওয়াড়ি এক ভেজ রেষ্টুরেন্টে ডিনার করে রুমে ফিরলে এলাম। এদের খাবার আমাদের ভাল লেগেছে। পোখারায় বাকি দিনগুলোতে আমরা এখানেই খেয়েছি। পরের দিনের গন্তব্য পীস প্যাগোডা এবং আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু সারাংকোট, যেখান থেকে হিমালয়ের অন্নপূর্ণা মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে!

পীস প্যাগোডা ও সারাংকোট এই দুই স্পটের জন্য ট্যাক্সি ঠিক করলাম। এটাও হোটেল থেকেই বুকিং করে নিলাম। আসলে চাইলে নিজেই দেখে-শুনে ট্যাক্সি ঠিক করা যায়। আমাদের প্ল্যানও তেমনই ছিল। কিন্তু এত জার্নির পর আর এইসব ঝামেলায় যেতে মন চাইল না।

প্ল্যান হল দুপুর ১২ টায় সারাংকোট যাব। এরপর পীস প্যাগোডায় সানসেট দেখবো। অবশ্য প্রচলিত নিয়ম হল, সারাংকোটে সানরাইজ দেখা। কিন্তু কয়েকদিন ধরে আমরা লক্ষ্য করছিলাম যে, সকালটা কুয়াশাচ্ছন্ন থাকে। দিন যত গড়ায় আকাশ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকে। অবশ্য এর সাথে নিজের সৌভাগ্যও সাথে থাকতে হবে। কারণ আমাদের আগের দিন সারাদিনই আকাশ কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল।

তো প্ল্যান মাফিক আমরা আনুমানিক ১২ টার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। কিন্তু আমরা একটা বিষয়ে দ্বিধায় ছিলাম যে সানসেট কোথায় দেখবো- পীস প্যাগোডয় নাকি সারাংকোট? ড্রাইভারকে একথা জিজ্ঞেস করতেই সে যেন আকাশ থেকে পড়ল! কারণ হোটেল ম্যানেজার আবারো ভজগট পাকিয়ে দিয়েছে। সে ড্রাইভারকে সানসেটের কথা বলেনি। তাই ড্রাইভার আমাদের সাথে গাঁইগুঁই করতে লাগলো। পরে তাকে বলা হল যে সে যাতে এ ব্যাপারে সরাসরি ম্যানেজারের সাথে ডিল করে। অবশেষে সে মেনে নেয়।আর আমরা আমাদের পরিকল্পনা মত আগে সারাংকোট যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

পোখারা শহর অনেক পরিচ্ছন্ন। জনজীবনে খুব একটা ব্যাস্ততা নেই। শহরের যে পথেই যাওয়া যাক না কেন দিগন্তে হিমালয়ের উঁকিঝুঁকি দেখা যাবেই। সারাংকোট যাওয়ার পথেও প্রায়ই অন্নপূর্ণা উঁকি দিচ্ছিল। আমরাও সুযোগ পেলেই দেখে নিচ্ছিলাম। আমাদের গাড়ি যখন আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে ওঠা শুরু করল তখন বুঝে নিলাম যে প্রায়ই এসে গেছি। এবার অন্নপূর্ণা আর চোখের আড়াল হচ্ছে না। বরং এর ব্যাপ্তি বেড়ে চলেছে। প্রায় ৪০ মিনিটের যাত্রা শেষে আমরা সারাংকোট এসে পৌঁছালাম। গাড়ি একটি সিঁড়ির গোড়ায় নামিয়ে দিল। এই পথে ১০ মিনিট উঠলেই দেখা মিলবে হিমালয়ের অন্নাপূর্ণা রেঞ্জ। খাড়া সিড়ি দিয়ে উঠতে বেশ বেগ পেতে হল আমাদের। সিঁড়ি শেষ হতেই ঢালু মত রাস্তা পড়লো। সেই রাস্তার মাঝপথে আসতেই হুট করে দেখা দিল বিশাল এক সাদা অবয়ব। হিমালয়!

Annapurna Range,Pokhara

আরো কিছু পথ এগিয়ে যেতেই দেখা গেল সেই কাংখিত দৃশ্য যার জন্য সারাংকোটের নাম-ডাক। অন্নপূর্ণার প্যানারোমা ভিউ। দিনটি রৌদ্রোজ্জ্বল ছিল। দুপুরের গনগনে সূর্য মাথার উপর। কিন্তু হিমালয়ের দোরগোড়ায় আসলে সেই রোদের তীব্রতা অনূভুত হবেনা সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার কোন ব্যাপারও নেই। দিগন্তে অন্নপূর্ণার চূড়াগুলো সব মাথা উঁচিয়ে আছে। হঠাৎ চোখ পড়লো ফিশটেইল নামক একটি চূড়ার উপর। দেখতে অনেকটা মাছে লেজের আকৃতির। কিন্তু আমার কাছে মনে হল যেন শক্ত চোয়ালের কোন এক আগন্তুক কালো রঙের বিরাট এক আলখেল্লা গায়ে দাড়িয়ে আছে। অন্নাপূর্নার এক একেকটি চূড়া একেক রকম দেখতে। কিন্তু একটি জায়গায় সবার মিল। সবগুলো চূড়োই বরফে মুড়ানো। এর মধ্যে একটি চূড়োর ঠিক উপরেই এক খন্ড মেঘ অনেকক্ষন ঘোরাঘুরি করছিল। দেখে মনে হবে হাজার বছরের গল্পের ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোন এক এলো চুলের বৃদ্ধ।

বাতাসে হালকা কুয়াশা ছিল। আমরা যেখানটায় ছিলাম তার অনেক নিচে একটা জনপদ দেখা যাচ্ছিল। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম। দূরে কি যেন রঙ্গিন দেখা যাচ্ছে। ভাল করে দেখে বুঝলাম, ওরা প্যারাগ্লাইডার। সারাংকোট প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য বিখ্যাত। কয়েকজন প্যারাগ্লাইডার ঘুরতে ঘুরতে আমাদের মাথার উপর চলে এল। উড়োজাহাজের সফলতার আগে মানুষ বিভিন্ন পদ্ধতিতে উচু স্থান থেকে ওড়ার চেষ্টা করতো।বিজ্ঞানের আশীর্বাদে আজ মানুষ গ্রহের বাইরেও উড়ে চলে যায়। কিন্তু এখন মানুষ আবার কয়েকশ বছর আগের মত করে আকাশে ওড়ে। পার্থক্য হলে আগে করতো প্রয়োজনে বা আবিষ্কারের নেশায় আর এখন শখে। কি অদ্ভুদ মানুষের চাওয়াগুলো! ভাবলাম আমি।

Paragliding at Sarangkot

দেখতে দেখতে কিভাবে যে তিন ঘন্টা উড়ে চলে আমরা টের পেলাম না। সন্ধ্যা যত ঘনিয়ে আসছে কুয়াশার প্রকোপ তত বাড়ছে। পাশেই একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। সেখানে রাখা ২০০০ মি.মি জুম লেন্স দিয়ে হিমালয়কে নাকের ডগায় এনে দেখা যায়। ঠিক যেন আপনি এর কাছেই রয়েছেন। চলে যাচ্ছি করেও আমরা আরো অনেকক্ষন কাটিয়ে দিলাম। হিমালয়ের চূড়াগুলো আর তার কোলের সবুজ উপত্যাকাটি আরেকবার দেখে নিলাম। এরপর আর দেরি করলাম না। সাদা দৈত্যাকার পর্বতশ্রেনীকে পেছনে রেখে আমরা রওনা দিলাম গাড়ির দিকে।

পরের গন্তব্য সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ওয়ার্ল্ড পীস প্যাগোডা

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Share
Tweet
Pin
Share