পীস প্যাগোডা সারাংকোট থেকে প্রায় ঘন্টা খানেকের পথ। এই পথ তুলনামূলক খাড়া। আবার গাড়ি যেখানে নামিয়ে দেয় সেখান থেকেও অনেকটা পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। যদিও সিঁড়ি করা পথ। প্রায় ১৫-২০ মিনিট পথ পাড়ি দিয়ে যখন আমরা সেখানে পৌছালাম মনে হল এইখানে না আসলে অনেক বড় ভুল হয়ে যেত। সমূদ্রের প্রায় ১০০০ মিটার উপরের থেকে যখন একই সাথে লেইকের জলরাশি, পাহাড়ের স্তর ও সব শেষে হিমালয়ের ঢেউ খেলানো সারি চোখে পড়লো তখন মনে হল, আর কি চাই!

এই প্যাগোডায় অনেক মানুষের আসা যাওয়া আছে। সবাই নিজের মত করে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। তাই এখানে আসলে যে বিষয়ে বেশী সতর্ক থাকলে হবে তা হল, সাইলেন্স! বেশ কয়েক জায়গায় এই নির্দেশনা দেয়া আছে। ১১৫ ফিট উঁচু এই প্যাগোডাকে কেন্দ্র করে বৃত্তাকার যে রাস্তা আছে তাতে ঘুরলে চোখে পড়বে নানা রকম বৈচিত্র। বার্ডস আই ভিউতে ফেউয়া লেইকের পাশে পোখারা শহরের বাড়ি গুলোকে ছোট ছোট দেখাচ্ছে। এরপর রয়েছে সবুজ পাহাড়ের দল আর এদের ঠিক পেছনেই অন্নপূর্নার ঢেউ।

Sarankot, Pokhara, Nepal

সেই ঢেউয়ে নিজেদের ভাসিয়ে না দিয়ে আমরা বাস্তব জগতে ফিরে এলাম। এবার ফেরার পালা। পরের দিন কাঠমান্ডু যাওয়ার বাস সকাল সাতটায়। এবারো রিভার সাইডে সিট নিলাম। কাঠমান্ডু ফিরতে ফিরতে প্রায় চারটা বেজে গেল। পথের জ্যামে কিছু সময় গেল। এবার কাঠমান্ডু রিসোর্ট হোটেলে উঠলাম। আমাদের পরের দিনের প্ল্যান চন্দ্রগিরি এবং নগরকোট। মাঝখানে ভক্তপুর দর্শন।

সকাল সাড়ে দশটায় গাড়ি চলে এল। প্রথম গন্তব্য চন্দ্রগিরি। এখানে যাওয়ার এক মাত্র উদ্দেশ্যে হল ক্যাবল কার। মনকামনা নামক জায়গায়ও ক্যাবল কার আছে এবং ঐটি বেশ পুরানো যার ফলে সবাই ক্যাবল কার বললেই মনকামনা দেখিয়ে দিবে। কিন্তু কাঠমান্ডু থেকে মনকামনা প্রায় তিন ঘন্টার দূরত্ব। আরো সহজ করে বললে পোখারা যাওয়ার মাঝপথেই মনকামনা। অনেকেই পোখারা থেকে ফেরার সময় মনকামনায় নেমে যান। এরপর কোন এক রেষ্টুরেন্টে ব্যাগেজ রেখে (পেইড) ক্যাবল কার ঘুরে আসেন। এই ক্ষেত্রে কাঠমান্ডু ফিরে যেতে হলে লোকাল বাস বা ট্যাক্সি নিয়ে যেতে হবে।

সেই তুলনায় চন্দ্রগিরি থামেল থেকে প্রায় মিনিট চল্লিশের পথ। মানুষের ভিড় খুব একটা নেই। তবে চেষ্টা করবেন ছুটির দিন এভয়েড করতে। এইদিন ভিড় বেশী থাকে। আমরা যখন পৌছাই তখন এগারোটার কিছু বেশী।

একটি মাত্র ক্যাবলে কারটি ঝুলানো। ভেতরে ভেতরে কিঞ্চিত ভয় কাজ করছিল। ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল ক্যাবল কার প্রায় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী কোণে ক্যাবল বেয়ে উপরে ওঠা শুরু করলো।

Chandragiri cable, Katmundu

বাইরে তাকিয়ে দেখলাম, ল্যান্ডিং ষ্টেশন ছেড়ে আমরা উপরে উঠতে শুরু করেছি। আর কাঠমান্ডু শহর ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করেছে। আমাদের দুপাশে পাহাড়। সকালের কুয়াশা তখনো কাটেনি। কিন্তু তাই বলে চারপাশের সৌন্দর্যের কোন ঘাটতি ছিলনা। কুয়াশা ভেদ করে আসা সকালের রোদ দেখে মনে হচ্ছিল পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সূর্য কিরণ।

কিছুদূর চলতেই মহাশয় হিমালয় আবার সামনে এলেন। শহর, নদী পেরিয়ে। সেই দিগন্তে। স্বরূপে। তারমানে অনেক উপরে উঠে গেছি আমরা। সামনে তাকিয়ে দেখলাম আরো অর্ধেকের মত বাকি। উপরের দিকে যাচ্ছি বলে সময় নিচ্ছে বেশী। যদিও চারপাশ দেখতে দেখতে সময় বেশ যাচ্ছিল। একসময় আমরা গন্তব্যে পোঁছে গেলাম।

ক্যাবল কার থেকে বাইরে বের হতেই যেন এক রাশ ঠান্ডা ঝাপটে ধরলো। যেখান থেকে এলাম আর যেখানে এলাম – দুই জায়গার তাপমাত্রার পার্থক্য খুবই স্পষ্টভাবে ধরা দিল। তখন প্রায় এগারোটা। মাথার উপর সূর্য। কিন্তু চারিদিকের পরিবেশ হিম শীতল। এবং সেটাই স্বাভাবিক। কারণ আমরা রয়েছি সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৫০০ মিটার উপরে!

Chandragiri hill cable katmundu
Chandragiri, cable Katmundu

এই উচ্চতা থেকে কাঠমান্ডুর ঘরবাড়ি সব খেলনার মত মনে হচ্ছিল। দূরে পাহাড়ের সারি। আর তারপর হিমালয়। আমরা চারিদিকে ঘুরেফিরে দেখলাম। এখানে একটা মন্দির আছে। বাচ্চাদের খেলার ছোট একটা জায়গাও আছে। মন্দিরকে ঘিরে বৃত্তাকার পথ রয়েছে। সেই পথ ধরে হাঁটলে চারিপাশ দেখা হয়ে যাবে। কোন পাশে শহরের জঞ্জাট, কোনোদিকে হিমালয়ের হাতছানি আবার কোনোদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়ের সারি। কিভাবে যেন এক ঘন্টা উড়ে চলে গেল। একটা বাজতে তখন মিনিট কয়েক বাকি। ফেরার জন্য আবার ক্যাবল কারে চড়ে বসলাম। এইবার একটু দ্রুত এলাম।

ফিরে আসতেই আমাদের ড্রাইভার সাহেব জানালেন যে, বেলা একটা থেকে দু’টা পর্যন্ত ক্যাবল কার বন্ধ থাকে। তার মানে আর কয়েকমিনিট দেরি হলেই আমরা দু’টা পর্যন্ত আটকে যেতাম। অমন জায় জায়গায় সারাদিনই কাটানো যায়। কিন্তু আমাদের তো আরো কয়েক জায়গায় যেতে হবে। মাপা সময়। পরের গন্তব্য ভক্তপুর এবং নগরকোট। আমরা আগে ভক্তপুরে রওনা দিলাম। চন্দ্রগিরি থেকে ঘন্টা খানেকের পথ। পৌঁছানোর কিছু আগে রাস্তা ভাগ হয়ে দুইদিকে চলে গেছে। একটি চলে গেছে ভক্তপুর এবং আরেকটি গেছে চীনের তিব্বতের দিকে। ঐ পথে ২/৩ ঘন্টা এগুলেই তিব্বত! তিব্বতে যাওয়ার আশা মনে নিয়ে ঘুরছি অনেকদিন যাবত। সেই তিব্বত এত কাছে ভাবতেই শিহরিত হলাম।

Bhaktapur Durbar Square

ভক্তপুর পৌঁছে গেলাম। ভক্তপুর বহু পুরানোএক শহর। এর রয়েছে সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এই শহরের নির্মিত স্থাপনাগুলো বেশ নজর কাড়া। এবং এর নির্মাণশৈলী কিছু ক্ষেত্রে আপনাকে অবাক করবে। তবে ঘুরতে ঘুরতে পথ হারিয়ে ফেলবেন না যেন। আমরা হারিয়ে ফেলেছিলা্ম এবং পরে স্থানীয় একজনের সাহায্যে আমাদের গাড়ির কাছে ফিরে আসি। এরপর আমরা দিনের শেষ গন্তব্য নগরকোট রওনা দিলাম।

ভক্তপুরের কাছেই নগরকোট। নগরকোট ওঠার রাস্তা বেশ খাড়া এবং বিপজ্জনকও বটে। পাহাড়ের চারিদিকে বৃত্ত রচনা করে উপরে উঠতে শুরু করলাম আমরা। নগরকোটের বাড়িগুলো নিচে পড়ে রইল। ধীরে ধীরে ছোট হতে শুরু করলো। আমরা যখন নগরকোট ভিউপয়েন্ট এসে পৌঁছালাম তখন সূর্যাস্তের আর বেশী বাকি নেই। তবে ঐ সময়টা কুয়াশার প্রকোপ ভালই ছিল। আকাশ সম্পূর্ন পরিস্কার থাকলে এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্গা এমনকি ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এভারেষ্টের ছোট অবয়বের দেখাও মিলতে পারে। এখানে একটা ওয়াচ টাওয়ারও আছে। যতই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল হিমালয়ের রঙ বদলাতে শুরু করলো। ক্ষণে ক্ষণে এই রঙবদল সময়কেও বয়ে নিয়ে যায়। চন্দ্রগিরির মত এইখানেও বেশ ঠান্ডা। অবশ্য তাতে এত বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। হিমালয়ের গা ছুঁয়ে আসা বাতাস যে ঠান্ডা হবে তা তো জানা কথাই।

এবার সূর্যের দিকে মনযোগ দিলাম। অবশ্য বলা ভালো যে, এমন পরিবেশে সূর্যের টকটকে লাল মন কেড়ে নিল। বিস্তীর্ণ সবুজ ও পাহাড়ের ওপারে সূর্য অস্ত যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সূর্যাস্তের শেষ মূহুর্তের প্রতিটি ক্ষন যে অনূভুতি দিবে তা যে কারোরই দীর্ঘদিন মনে থাকবে। সূর্যাস্ত শেষে ধীরে ধীরে নেমে এলাম। হিমালয়ের সাথে আমাদের এখানেই শেষ দেখা। কারণ পোখারায় যেখানে-সেখানে হিমালয়ের দেখা মিললেও কাঠমান্ডুতে হিমালয় দেখতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়।

Sunset, Nagarkot, Nepal

পাহাড় ছেড়ে লোকালয়ে ফিরে এলাম। লোকাল মার্কেটে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে রাতের খাবার খেয়ে রুমে চলে এলাম। পরের দিন কোন ব্যাস্ততা নেই। নিজের মত করে ঘুরে বেড়াবো। আশেপাশে কিছু লোকেশানে যাব আর শহরটাকে নিজের চোখে দেখব এই রকমই প্ল্যান। তো প্ল্যান মত, সকালে বের হয়ে কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার গেলাম। থামেল থেকে পায়ে হেঁটেই গেলাম। অনেকটা ভক্তপুরের মতই মনে হল। ইতিহাস ও কালের সাক্ষী হয়ে আছে এর পুরানো স্থাপত্যগুলো। রয়েছে পুরানো সব মন্দির। এরপর আমরা গেলাম সয়াম্ভুনাথ মন্দির। ঐখানেও হেঁটেই গেলাম। উদ্দ্যশ্য কাঠমান্ডুর জনজীবন যতটকু কাছ থেকে দেখা যায়। যতক্ষণ তাদের এলাকাগুলোর মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলাম ভালই লাগছিল। প্রায় আধাঘন্টা পর পৌঁছে গেলাম সয়াম্ভুনাথ মন্দির। এর আরেক নাম মাঙ্কি টেম্পল। কেন যদি জানতে চান তাহলে বলবো গেলেই বুঝবেন।

😛 একটা বানর তো এসে আমার হাত থেকে পানির বোতল টেনে নিয়ে গেল। প্রথমে বুঝতে পারিনি। কিন্তু যখন টের পেলাম ততক্ষণে বোতল আমার হাতছাড়া।

Swayambhunath Temple, Kathmandu

অনেক গুলো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হল। তবে একটু কষ্ট করে উঠার পর সব নিমিষেই ভুলে গেলাম। সুউচ্চ বৌদ্ধ মন্দির ও তাঁকে ঘিরে আরো যে নানান আয়োজন, তা সত্যিই দারুন। এখান থেকেও কাঠমান্ডু শহরকে বার্ডস আই ভিউতে দেখা যায়। যদি হাতে সময় থাকে সূর্যাস্তও দেখা যায়। তবে আমাদের অন্য প্ল্যান ছিল। তাই নেমে এলাম আবার।

রাতে হোটেলে ফিরে বিল ক্লিয়ার করলাম। পরের দিনে যাত্রা বাংলাদেশ। হিমালয়ের দেশ থেকে বিদায় নেয়ার আগে শেষ দেখা হিমালয় ছাড়া অন্য কিছু হলে কেমন দেখায়? আপনি হিমালয়ের দেশে এলেন, হিমালয় দেখলেন, কিন্তু শেষ স্মৃতি নিয়ে ফিরলেন অন্য কোন কিছুর। তা কি করে হয়? অবশ্য আপনার ভ্রমন প্ল্যান যদি ঐরকমই হয় তাহলে তো আর কিছু করার নেই।

কিন্তু,না। হিমালয় তো তা হতে দেবে না। আপনি যখন বিমানে চেপে দেশের পথ ধরেছেন, মাঝপথেই দেখবেন স্বয়ং হিমালয় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে বিদায় জানাতে কিংবা আবার ফিরে আসার নিমন্ত্রন করতে। সেই হাতছানি আপনাকে মূহুর্তের জন্য ভাবতে বাধ্য করবে যে, আবার যদি আসতে পারতাম!

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share21
Tweet
Pin
Share