আচমকা ঘোষণা এল, আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ল্যাণ্ড করবে বিমান। জানালা দিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করলাম। মেঘের দাপটে স্পষ্ট কিছু বোঝা যাচ্ছেনা। তারপরও তাকিয়ে রইলাম। কয়েক মূহুর্ত পর মেঘ সরে গেল। কয়েকখন্ড সবুজ দৃশ্যমান হল অনেক নিচে। আস্তে আস্তে সবুজের পরিমান যেন বাড়ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওগুলো সব দ্বীপ। দ্বীপের নাম নিশ্চয়ই আন্দামান!
বংগোপসাগরের কোলে অবস্থিত আন্দামান এন্ড নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। ভারতের ভিসা নিয়েই আন্দামান যেতে হয়। তাই ভিসা পাওয়ার পরপরই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি বিমানে আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার যাওয়া যায়। কিন্তু এতে খরচ পড়ে যায় অনেক বেশী। আবার কলকাতা থেকেও যাওয়া যায়। লোকাল রুট হওয়ায় এই পথে খরচ অনেক সাশ্রয়ী। তাই ঠিক করলাম আগে কলকাতায় যাব এবং এরপর কলকাতা থেকে লোকাল ফ্লাইট ধরে পোর্ট ব্লেয়ার। সবার আগে ঢাকা থেকে কলকাতা মৈত্রী ট্রেনের টিকিট নিশ্চিত করলাম। এই টিকিট, ভ্রমনের ৩০ দিন আগ থেকেই নেয়া যায়। মৈত্রী ট্রেনের প্রচুর চাহিদা আছে। তাই যত আগে পারা যায় নিয়ে নেয়াই ভাল। ৪ ফেব্রুয়ারীর ট্রেনের টিকিট নিয়ে নিলাম। ট্রেনের সিটের ব্যবস্থা করে বিমানের সিটের দিকে নজর দিলাম।
ট্রেনের সিটের নির্দিষ্ট দাম থাকলেও বিমানের সিটের বেলায় তার উলটো। একেক সময় একেক রকম। যেহেতু আমি ৪ তারিখ কলকাতা পৌঁছাবো সেহেতু ৫ তারিখের ফ্লাইট ধরাই ভাল হবে। অনলাইনে দেখলাম ৫ তারিখ স্পাইস জেট (Spice Jet) সহনীয় রেইটে কলকাতা থেকে পোর্ট ব্লেয়ারের টিকিট দিচ্ছে। তাই আর দেরী না করে তাদের গুলশান অফিসে গিয়ে যাওয়ার টিকিট কিনে নিলাম।এবার পোর্ট ব্লেয়ার থেকে আসার টিকিট ব্যবস্থা করার পালা। অনেকে ফিরতি টিকিট পরে কাটেন। কিন্তু আমি সেইফ সাইডে থাকতে চাইছিলাম। কারন টিকিটের দামের এবং প্রাপ্তির কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই আন্দামানের মোটামুটি একটা ভ্রমন পরিকল্পনা করে ৯ ফেব্রুয়ারী কলকাতায় ফিরে আসব বলে ঠিক করি। ৯ তারিখের ফিরতি ফ্লাইটের জন্য ইন্ডিগোর (Indigo) রেইট ছিল বেষ্ট। এইবার আর তাদের অফিসে না গিয়ে আমি সরাসরি অনলাইনেই তাদের টিকিট নিয়ে নিই।টিকিট পর্ব শেষ। এইবার তা কাজে লাগানোর পালা। ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখ ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ষ্টেশন থেকে সকাল ৮ঃ১৫ তে ট্রেন ছাড়বে। কিন্তু ইমিগ্রেশনের জন্য সকাল ৬ টায় উপস্থিত হয়ে গেলাম। সংগে আছে বউ।
ইমিগ্রেশনের ফর্মালিটিস শেষ করে আমরা যখন ট্রেনে বসলাম তখন ৭ টা বেজে গেছে। এখন শুধু অপেক্ষা ট্রেন ছাড়ার!ট্রেন ছেড়ে দিল এবং আমরা কলকাতা ষ্টেশনে পৌঁছেও গেলাম।
তখন প্রায় সন্ধ্যা ৫ টা। আবারো ইমিগ্রেশনের স্তর পার হয়ে যখন মার্কুইজ স্ট্রিটের হোটেলে পৌঁছালাম তখন খেয়ে দেয়ে ঘুম ছাড়া আর কোন কিছু মাথায় আসছিলো না। যদিও ইতিমধ্যেই আমার ক্যামেরা হারানো এবং তা ফিরে পাওয়ার মত ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু সেই গল্প এইখানে করছিনা। পরদিন দুপুর ২ঃ৪০ মিনিটে ফ্লাইট। আমরা সকালেই উঠে গেলাম। প্রয়োজনীয় কাগজ ও টাকা-পয়সা চেক করে নিলাম। হটাৎ মনে হল বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার টিকেট তো নেয়া হয়নি। আর ট্রেনের টিকিট তো আগেই নিতে হবে। বিমানবন্দরে যাওয়ার আগেই ট্রেনের টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারলে মন্দ কি? হোটেলের কাউন্টারে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, টিকিট কাউন্টারে অনেক লম্বা লাইন হয় আবার বিমানবন্দরে যেতেও জ্যাম হতে পারে। ওনার এই কথায় দ্বিধায় পরে গেলাম। অবেশেষে ট্রেনের টিকেট ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যেই রওনা হলাম। পরবর্তীতে আমরা বুঝেছিলাম যে আগে ট্রেনের টিকেটের ব্যবস্থা করতে গেলে প্লেন আমাদের মাথার উপর দিয়ে চলে যেত।
উল্লেখ্য, ভাগ্য আমাদের সহায় ছিল। আমরা আন্দামান থেকে ফিরে এসে ট্রেনের টিকেট পেয়েছিলাম।বিমানবন্দরে পৌঁছে স্পাইস জেটের বোর্ডিং পাস নেয়ার সময় হল আরেক বিপত্তি। আন্দামানগামী বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী দেখে বিমান এজেন্ট যেন হটাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে অন্য টেবিলে গিয়ে কি যেন কানাকানি করলেন। ঐদিকে আমরা ভাল মন্দ কিছু ভাবতে পারছিনা। তাকিয়ে শুধু ঐ এজেন্টের কর্মকান্ড দেখছি। ইতিমধ্যে তিনি এলেন এবং কোথায় যেন ফোন করে আমাদের আন্দামানে যেতে দেয়া যাবে কিনা তার অনুমতি চাইলেন। এবং অনুমতি মিলল!এইবার শতভাগ রিল্যাক্স, মনে মনে ভাবলাম। ৪ তারিখ ভোর ৫টায় শুরু হওয়া দৌড়াদৌড়ির পর এতক্ষণে একটু অবসর পাওয়া গেলো। জীবনে প্রথমবারের মত বিমানে উঠে বসলাম এবং যথাসময়ে বিমান আকাশে উড়লো। জানালা দিয়ে অপরিবর্তিত আকাশ দেখার বিরক্তি নিয়ে কখন যেন ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাংগলে দেখলাম ল্যান্ডিং এর প্রস্তুতি চলছে। বাইরে তাকাতেই আকাশে কালো মেঘের বিশাল পাহাড় চোখে পড়ল। পাশ কাটাতেই নজরে এল, আন্দমানের ছোট অবয়ব! ক্রমশ বড় হয়ে আসছে। নীল জলরাশি পেরিয়ে আমরা ছুটে যাচ্ছি আন্দমানের দ্বীপে।
আন্দমান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ প্রায় ৫০০ টিরও বেশি দ্বীপ আছে। তন্মোধ্যে, শুধুমাত্র আন্দমানেই পর্যটক যাওয়ার অনুমতি আছে। নিকোবর সংরক্ষিত এলাকা। আবার আন্দমানেও সব দ্বীপে পর্যটক যায়না বা নিয়ম নেই। তবে যে কয়টি দ্বীপে যাওয়া যায় তাতে আপনি মাস খানেক সময় হাতে নিয়ে গেলেও সব দেখা হবে কিনা তা আমি নিশ্চিত নই। তবে আমরা আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর না নিয়ে, প্রচলিত ৩/৪ টি দ্বীপ দেখবো বলে ঠিক করলাম। পোর্টব্লেয়ার,হেভলক, নীল আইল্যাণ্ড ও রস আইল্যান্ড। উল্যেখ্য এই সব দ্বীপে যাওয়ার জন্য দুই ধরনের ব্যবস্থা আছে – সরকারী ফেরী, যার ভাড়া কম কিন্তু টিকিট পাওয়া কঠিন এবং বেসরকারী ক্রুজ, যা ভাড়া বেশী এবং টিকিট পাওয়া তুলনামূলক সহজ।
ইতিমধ্যে আমাদের বিমানের ল্যান্ডিং হয়ে গেল। কলকাতা থেকে আন্দমান পৌঁছাতে ২ ঘণ্টা লাগলো। যে কোন বিদেশী নাগরিক আন্দামান ভ্রমন করতে হলে পোর্ট ব্লেয়ারে পৌঁছানোর পর বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। এই তথ্য জেনেই গিয়েছিলাম। তাই বিমানবন্দরে নেমেই সেই অনুমতি পত্র নিতে চলে গেলাম। কিন্তু তা করতে গিয়ে দেখলাম এটা আসলে আরেকটা ইমিগ্রিশানের মতই। মানে আমাদের পাসপোর্টে ভারতের সিলতো বটেই পোর্ট ব্লেয়ারের সিলও পড়লো। সেই সাথে একটি ফর্ম পূরণ করতে হল এবং এরপর একটি অনুমতি পত্র দেয়া হল। উল্ল্যেখ্য, এই কাগজই এখন পাসপোর্টের সমতুল্য। আন্দামানের যতদিন থাকি, যেখানেই যাই, এমনকি ফেরত যাওয়ার সময়ও এই কাগজ অতি, অতি এবং অতি আবশ্যক। এই অনুমতি পত্র ছাড়া কোন হোটেলও আপনাকে জায়গা দিবেনা।
অনুমতি পত্র নিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে এলাম। কোন হোটেলে উঠবো এখনো জানিনা। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আমি এই ট্যুরে কোন হোটেল বুকিং দিইনি। তবে সুবিধাজনক জায়গা বুঝে কলকাতা এবং পোর্ট ব্লেয়ারের ২/১ টা হোটেলের নাম টুকে নিয়েছিলাম। এতে মূলত দুটি সুবিধা হয়েছে ঃ ১) পোর্ট ব্লেয়ারের ইমিগ্রিশনের ফর্মে হোটেলের নাম দিতে পারা গেছে। ২) একটা হোটেল থাকা মানে তার আশে পাশে আরো হোটেল আছে। সুতারাং ঐখানে পৌঁছাতে পারলে নিজের পছন্দ মত হোটেলে বের করা যাবে।
বিমানবন্দর থেকে বের হতেই ট্যাক্সি বা অটো ড্রাইভাররা আপনাকে পেয়ে বসবে। ভাড়ার ব্যাপারে আগেই কথা বলে নেয়া ভাল। ট্যাক্সি বলতে ওরা যা বুঝায় তা হল প্রাইভেট কার টাইপের বাহন। আর অটো হল আমাদের ব্যাবি ট্যাক্সি সদৃশ বাহন। চলা ফেরার জন্য অটোই সাশ্রয়ী। আমরা উঠলাম Hotel RNP তে। এয়ারপোর্টের কাছেরই একটি হোটেল। তখন প্রায় সন্ধ্যা।
ফ্রেশ হয়ে আবার বের হলাম। আন্দামানের সবচেয়ে বড় একটি বৈশিষ্ট্য হল নিরাপত্তা। আন্দামানের যে কয়টি দ্বীপেই গিয়েছি তার প্রমানও পেয়েছি। সবাই এইখানে নিশ্চিন্ত মনেই যে কোন জায়গায় চলাফেরা করতে পারে, যে কোন সময়ই। আমরা দুজনও বেশ খানিক্ষন ঘুরলাম । উদ্দেশ্য ছিল লোকালয় ঘুরে ফিরে দেখা। বেশ ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন শহর পোর্ট ব্লেয়ার। উচুনিচু পাহাড়ী রাস্তা কোথাও কোথাও হটাৎ উঠে বা নেমে গেছে। পিচ ঢালা রাস্তার দুপাশেই গাছ। কোন কোন গাছে ফল ধরেছে। ভাল করে তাকাতেই দেখি, ফলের নাম আম। ফেরুয়ারিতে আম! পরে খবর নিয়ে জানতে পারলাম, আন্দমানের সারা বছরই গাছে আম থাকে। পরে আমরা পাকা আমও খেয়েছি।
হোটেলে ফিরে হেভলক যাওয়ার ব্যাপারে খবর নিয়ে যা জানা গেল তা সন্তোষজনক ছিলনা। আমাদের প্ল্যান ছিল বেসরকারী ক্রুজের অগ্রিম টিকিট নিয়ে নেয়া। কিন্তু টিকিট সন্ধ্যার পর আর দেয়া হয়না! তবে সকালে সরাসরি জেটিতে গেলে পাওয়া যেতে পারে। সেই ভরসায় রাতে খাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে ৬ টার আগেই উঠে জেটিতে যেতে হবে। ঘড়িতে এলার্ম দেয়া ছিল। ঠিক সময়ে উঠে ঝটপট রেডি হয়ে গেলাম। একটা মজার তথ্য হল, আন্দামানে সকল হোটেলের চেক আউট টাইম সকাল ৮/৯ টা।
চেক আউট করে বের হতেই অটো পেয়ে গেলাম। ফিনিক্স জেটিতে পৌঁছাতে ১০ মিনিটের মত লাগলো। পৌছালাম বটে কিন্তু এরপর কোথায় যেতে হবে বা টিকিট কোথায় পাওয়া যাবে ইত্যাদি তা তো জানিনা। একজনকে সরকারী ফেরীর কথা জিজ্ঞেস করতেই একটি কাউন্টার দেখিয়ে দিল। গিয়ে জানা গেল হেভলকের টিকিট নেই। জানা কথা। এখন প্রাইভেট ক্রুজই ভরসা। আন্দামানে দ্বীপগুলোতে বেশ কয়েকটি প্রাইভেট ক্রুজ চলাচল করে। অনলাইনেই তাদের চলাচলের সময় ও রুট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।আমি আগেই Green Ocean 2 ও Makruz নামক দুইটি ক্রুজ বিকল্প হিসেবে নির্বাচন করে রেখেছিলাম। তাই সরকারী ফেরী যখন হাতছাড়া হয়ে যায় আমি Green Ocean 2 কাউন্টারের খুঁজতে থাকি। কিন্তু কোন হদীস পাওয়া গেল না।
ঐদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। নির্দিষ্ট সময় পর সকালের সকল নৌযান চলে যাবে আর দুপুরের আগ পর্যন্ত কোন ক্রুজ নেই। কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেও Green Ocean 2 কাউন্টার পেলাম না। পুরো ট্যুরে এই একবারই নিজেদের দিকবিদ্বিগশূন্য মনে হল। ইতিমধ্যে মনে মনে ভেবে নিয়েছি যে ক্রুজ না পেলে হোটেলেই ফিরে যাব এবং পরের দিনের টিকিট আগেই কেটে নিব। এই ক্ষেত্রে আমাদের একটি দ্বীপ কম ঘোরা হবে যেহেতু একটি দিন অপচয় হয়ে যাবে।
হঠাৎ একটি লাইন দেখতে পেলাম। এগিয়ে জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম এই লাইন ধরে গেলেই সকল ক্রুজের কাউন্টারের দেখা মিলবে। লাইনে দাঁড়িয়ে সামনে এগুলাম এবং একজন নিরাপত্তা প্রহরীর কাছ থেকে Green Ocean 2 এজেন্টের দেখা পেলাম। সময় নষ্ট না করে টিকিটে নিয়ে নিলাম। হাতে মাত্র ১০-১৫ মিনিট সময়। ব্যাগ ও সিকিউরিটি চেক শেষে ক্রুজে চড়ে বসলাম।
ক্রুজ ভালই লাগছিল। পুরোটাই এসি। কিন্তু চারিদিকে গেইট লক করা। মানে ক্রুজ চলমান অবস্থায় বাইরে বের হওয়া যাবেনা। ডেকে দাঁড়ানো বা বাইরের গায়ে বাতাস লাগানো ইত্যাদি করা যাবে না। বড়জোড় ভেতরে হাঁটাহাঁটি করা যাবে, ভেতরের ডাইনিংএ যাওয়া যাবে ইত্যাদি। এটা জানার পর বিরক্তই লাগলো। কাঁচের জানালা দিয়েই যা দেখার দেখতে হবে। কিন্তু কিছু করার নেই। এইটাই আন্দামানের সকল ক্রুজের নিয়ম। হটাত যেন ক্রুজ একটু বেশীই দুলতে শুরু করলো। বাইরে তাকালাম। ঢেউ গুলোকে বেশ বড় বড়ই মনে হচ্ছে। আবার এমনও হতে পারে এইটাই আন্দামানের সাধারন ঢেউ, এই বলে মনকে প্রবোধ দিলাম। আকাশে তাকি্যে দেখলাম, সূর্য দেখা যায়না। তার মানে মেঘ আছে। মনের সন্দেহ গভীর হল। একজন কেবিন ক্রুকে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই, তিনি জানালেন, “আবহাওয়া একটু খারাপ বটে তবে এটা দুশ্চিন্তা করার মত কিছুনা। আবহাওয়া যখন সত্যিই খারাপ থাকে তখন ঢেউ গুলো দোতলার জানালায় আছড়ে পড়ে!” উল্লেখ্য, আমরা দোতলায়ই বসে ছিলাম। তার এই কথায় একটু আশ্বস্ত হলাম। জানালা থেকে ঢেউ এখনো অনেক দূরে আছে।
হেভলকে পৌছাতে ২ ঘন্টার মত লাগলো। নামার পর জেটি গেইট থেকে বের হতেই অনেক ট্যাক্সি বা অটো ড্রাইভারের ভিড় কাটিয়ে অটো ষ্ট্যান্ডে চলে এলাম। ওইখানে সিরিয়াল থাকে। একজন অটো চালকের সাথে কথা বলে নিলাম। যেহেতু আমার কোন হোটেল বুকিং নেই তাই উনি আমাকে হোটেল দেখিয়ে দিবেন আমার পছন্দ হওয়ার আগ পর্যন্ত। এই ক্ষেত্রে আমি আমার বাজেট জানিয়ে দিলাম। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ মনে হল আমার তো পরের দিন নীল আইল্যান্ড যাওয়ার কথা! ক্রুজের টিকিট আগেই নিয়ে নেয়া উচিত। আবার এলাম জেটিতে। হেভলক থেকে নীল আইল্যান্ড যাওয়ার জন্য Green Ocean 2 এবং নীল আইল্যান্ড থেকে পোর্ট ব্লেয়ার ফিরে আসার Makruz এর টিকিট নিয়ে ফেললাম। এই বার নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।
অটো চালক আমাদের হোটেল দেখাতে লাগলেন এবং ৩ নম্বর হোটলটি আমাদের পছন্দ হল। কথা বলে উঠে পড়লাম। এটি মূলত একটি রিসোর্ট । সবার জন্য আলাদা আলাদা ঘর। রুমের সামনে ছোট বারান্দামতন জায়গায় চেয়ার টেবিল পাতা। রিসোর্টের পুরো চত্বরটাই নারিকেল গাছে ঢাকা। আমাদের রুমের পাশ দিয়েই একটা পায়ে হাটা পথ চলে গেছে। সেই পথ ধরে ২/১ মিনিট কদম হাটলেই সমূদ্র!
আন্দামানে খাবার খরচ ও গাড়ি ভাড়া একটু বেশি। তবে সকল জায়গার খাবার মেনু এবং দাম প্রায় একই ছিল। সব হোটেলের নিজস্ব ডাইনিং আছে। চাইলেই ওদের ডাইনিং বা বাইরেও খাওয়া যায়। আর গাড়ি ভাড়া ৩/৪ কিলো রাস্তার জন্যই ১০০/১৫০ রুপি চেয়ে বসে তারা। wifi ও ব্যাবহার করতে পারবেন। তবে এই ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টার জন্য স্থান ভেদে ১০০-১৫০ রুপি লাগবে। স্থানীয়দের মতে, কথা বলার জন্য এয়ারটেলের নেটওয়ার্ক ভাল। ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ আছে এবং সকল হোটেলেই এসি/নন-এসি দুই ধরনের রুমই আছে।
ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়লাম। ঘরের কাছের সমুদ্র পাড়ে চলে এলাম। আকাশ মেঘলা ছিল ঐদিন। সমুদ্রে জোয়ার চলছিল। কিছু পর্যটক এদিক সেদিক অলস সময় কাটাচ্ছে। আমরাও নিজেদের মত করে উপভোগ করছি। হটাৎ মনে হল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। সাথে বাতাসও ছিল ভালই। পরে জানতে পারলাম আমরা আসার আগের দুই দিন হেভলকে ভালই বৃষ্টি হয়েছে। আরো কিছুক্ষন থাকার পর ফিরে এলাম। দুপুরে খেয়েদেয়ে বের হওয়ার প্ল্যান আছে।
হেভলক হল আন্দামানের সবচেয়ে জনপ্রিয় দ্বীপ। প্রচুর পর্যটক এখানে আসেন। বেশীরভাগই ইউরোপীয়ান।স্কুবা ডাইভিং, সী-ওয়াকিং, মাছ ধরা সহ নানা রকম কর্মকান্ডের জন্য হেভলক জনপ্রিয়। এখানে চাইলে দিন প্রতি হিসেবে মোটরসাইকেল ভাড়া নেয়া যায়। এতে করে নিজের ইচ্ছা মত ঘুরে বেড়ানো যায়। তবে নিজের ড্রাইভিং লাইসেন্স আবশ্যক। পুরো দ্বীপ জুড়েই প্রচুর নারিকেল গাছ। তাই বলে, ১ টাকায় আট মণ নারিকেল পাওয়া যাবেনা। দাম হিসেব করলে আমাদের দেশের মতই পড়ে। বিজনেস ইজ বিজনেস, ইওর অনার।
আমরা একটা অটো ভাড়া করে ঘুরে আসি কালাপাথর বীচ থেকে। সমুদ্রতটেই বালিতে ডেবে থাকা বড় বড় কালো পাথর দেখেই আমরা বুঝে নিলাম এই বীচের নামকরণের কারন। আকাশ তখনো মেঘাচ্ছন্ন। সাগরের নীল জলরাশি আছড়ে পড়ছে তীরে। সমূদ্রতীরে হরেক রঙের শামুক, কাঁকড়া নিজেদের মত করে ঘোরাফেরা করছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। আমরা ফিরে এলাম আমাদের অস্থায়ী কুটিরে।রাতের খাওয়া শেষে রাতের সমুদ্র দেখার বাসনা মেটাতে চলে এলাম ঘরের পাশের বীচে। গিয়ে দেখি ভাটা পড়ে গেছে। পানি অনেক দূর চলে গেছে। দেখা যায় না! তখন রাত ১০ টা বা তারও বেশী। তারপরো, আন্দামান শতভাগ নিরাপদ, এই কথায় বিশ্বাস রেখে আমরা আরো কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করে ফিরে এলাম হোটেলে। পরের দিনের গন্তব্য নীল আইল্যান্ড।
যথাসময় ক্রুজ ছেড়ে দিল নীলের উদ্দেশ্যে। একঘন্টা লাগলো পৌঁছাতে। নীল আইল্যান্ডেই বেশী ভাল লেগেছে।নীল আইল্যান্ড হল আন্দামানের সবচেয়ে ছোট দ্বীপ। এখানকার পানির অনেক রং হয়। কিছুদূর পর পর রঙ পরিবর্তন চোখে পড়ে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, পানির নিচে থাকা কোরালের কারনেই এমনটা হয়। স্থান ভেদে কোরালের ভিন্নতার কারনে সূর্যের কিরনে পানির নানান রঙ দেখা যায়। যাই হোক, জেটি থেকে বের হয়ে আবারো ট্যাক্সি ও অটো চালকদের ভিড় কাটিয়ে সামনে চলে এলাম। একজন অটোচালকের সাথে কথা বলে উঠে গেলাম। এবারো আগের মতই চুক্তি হল। হোটেল পাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি থাকবেন সাথে। প্রথম হোটেলেই পছন্দ হয়ে গেলো।
নাম কালাপানি।
এটাও নারিকেল গাছে ঘেরা আংগিনা। ভাগ্যক্রমে আবারো সমুদ্র পেয়ে গেলাম রুমের পাশেই। ফ্রেশ হয়ে এবং দুপুরের খাওয়া শেষ বের হলাম নীল দ্বীপ দর্শনে। বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পট আছে সেখানে। তবে আমরা গেলাম, ন্যাচারাল ব্রীজ, ধর্মতলা বীচ ও সানসেট বীচে। ন্যারাচাল ব্রীজ হল বড় একটা বৃত্তাকার কোরাল। স্থানীয়রা একে ন্যাচারাল ব্রীজ বলে। এখানে যাওয়ার আগে অনেক গাইড এসে ভীড় করলো। তাদের গাইড হিসেবে তাদের নেয়ার জন্য প্ররোরচিত করতে লাগলো। ওইসবে কান না দিয়ে নিজেই শেষ পর্যন্ত গিয়েছি এবং পরে বুঝেছি যে, ভালই করেছি।
সানসেট বিচে সূর্যাস্ত দেখে ফিরে এলাম। পরের দিন পোর্টব্লেয়ারে ফেরার পালা। নীল আইল্যান্ড থেকে পোর্টে ব্লেয়ারে যেতে অন্য সকল নৌযানে ২ ঘণ্টা লাগলেও Makruz সময় নেয় মাত্র ১ ঘন্টা! পোর্ট ব্লেয়ারে এসে আগের হোটেলেই উঠলাম। বিকেলে সেলুলার জেল ঘুরে এলাম। সেলুলার জেলের ছাদে উঠেই সবচেয়ে বেশী ভাল লেগেছে। ঐখান থেকে রস আইল্যাণ্ড দেখায় যায়। দূর থেকে দ্বীপটাকে অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে! সন্ধ্যার পর সময় কাটালাম মেলানি পার্ক ও আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। আন্দামান ভ্রমন প্রায় শেষের পথে। আন্দামানের প্রতিটি দ্বীপেই অনেক কিছু করার আছে, দেখার আছে। সবই নির্ভর করবে নিজের বাজেট ও সময়ের উপর। তাই শেষ হইয়াও হইল না শেষ মন নিয়ে পরের দিনের কলকাতার ফ্লাইট ধরতে হল আমাদের।
আমাদের বিমান যখন পোর্ট ব্লেয়ার ছেড়ে আসছিল ততক্ষণে আন্দমানে আরেকটি সুন্দর দিন শুরু হয়ে গেছে। আমরা ফিরে আসছি ইট-সিমেন্টের যান্ত্রিক জীবনে। আর আন্দামানের রঙ্গীন সমুদ্র ব্যস্ত রয়েছে নতুন অথিতিদের অভ্যর্থনা জানাতে