আর মাত্র মিনিট কয়েক আছে লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার। আমার মোবাইলের সময় বলছে এক মিনিট মাত্র বাকি, কিন্তু আরো কয় মিনিটের পথ দৌড়াতে হবে তা জানিনা। এই লঞ্চ মিস করলে আরো তিন ঘন্টা পর পরবর্তী লঞ্চ। যার মানে পুরো দিনতো বটেই সমস্ত প্ল্যানই মাটি। আর তাই লঞ্চঘাট বাজারের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া গলি-উপগলি পার হয়ে প্রায় যখন দৌড়ে যাচ্ছিলাম তখন সবকিছু ভাগ্যের উপরই ছেড়ে দিলাম।কিন্তু ভরসার জায়গা হল আমাদের কয়জন আগেই ঘাটে উপস্থিত ছিল এবং তারা লঞ্চে উঠে গেছে। তাদের অনুরোধে কিছু সময় আমরা পেতে পারি।বাজার পিছনে ফেলে লঞ্চ যখন আমাদের দৃষ্টিসীমায় এলো দেখলাম লঞ্চের পাটাতন তোলার আয়োজন চলছে। ভাগ্য তাহলে সহায়ই ছিল। আমরা উঠে পড়তেই আর দেরী করলো না তারা। ছেড়ে দিল লঞ্চ। উদ্দেশ্য অষ্টগ্রাম।

Astagram Kishorganj

 

ভোর ছ’টা থেকে শুরু হওয়া টানা পাঁচ ঘন্টার জার্নি আক্রান্ত দেহ নিয়ে যখন চলন্ত লঞ্চের ডেকে গিয়ে দাঁড়ালাম তখন সব কষ্ট উবে গেল। নদীর শান্ত জল ছুঁয়ে আসা বাতাস নিমিষেই সকল ক্লান্তি উড়িয়ে নিল যেন। প্রকৃতি আমাদের জন্য কি আয়োজন নিয়ে অপেক্ষা করছিল তা আমাদের ধারনায় ছিলনা। তবে লঞ্চ ধীরে ধীরে যতই নদীর গভীরে যাচ্ছে ততই তা আমরা উপলিব্ধি করলাম। মাঝ নদীতে গেলে শুধুই জল রাশি দেখার যে বিরক্তি, এই সফরে তা আমাদের এক মূহূর্তের জন্যও পেয়ে বসেনি। বরং নদীর দুপাশের রূপ বৈচিত্র আমাদের ব্যাস্ত রেখেছে সাধ্যমত।

কিছুদূর পরপরই জেলেদের মাছ ধরার বিচিত্র সব পদ্ধতি ছিল নজর কাড়ার মত। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ছেলে, বুড়ো এমনকি মহিলারাও ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছে। কেউবা বড়শি ফেলে একাকী বসে আছে নিস্তরংগ নদীতে। কেউ কেউ জাল ফেলে নৌকাতেই শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কোথাও আবার জোয়ানদল ভারী জাল নিয়ে ব্যাস্ত। কিংবা কোন মধ্যবয়সী জাল টেনে তুলছে মাছের আশায়, আর সূর্যের কিরনে সেই জাল চিকচিক করে উঠছে!

৪/৫ ঘণ্টার টানা নদী ভ্রমনে এত সবুজ কখনো দেখেছি কিনা মনে পড়ে না, যতটা সবুজ এই যাত্রায় চোখে পড়েছে। বিস্তীর্ণ জলরাশি। তার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ সবুজ গ্রাম। দূরে ছোট দ্বীপের মত অথৈ পানির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় কোন এক গৃহস্থ বাড়ি, সেই বাড়ি ঘিরেই অনেক গাছ। যেন একটা বাড়ি নিজেই একটা দ্বীপ! মাঝে মাঝে আবার একসাথে অনেক গুলো জলবেষ্টিত বাড়ি। কিন্তু কারো সাথেই কারো স্থল যোগাযোগ নেই বা থাকলেও তা পানির তলায়। বুঝতে বাকি রইলোনা শুকনো মৌসুমে অনেক জায়গায় স্থলপথ জেগে উঠলেও বর্ষায় নৌকা এইখানে অপরিহার্য এক সম্পদ।

Fishing Astagram Kishorganj

হ্যাঁ, শুকনো মৌসুমে এখানে পানির তলায় রাস্তা গুলো জেগে ওঠে। নদীর বুক চিরে আমরা যখন যাচ্ছিলাম তখন আমরা অবাক হয়ে দেখলাম, নদীর মাঝখানেই সেতু! এ সেতু নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার নয়। পানির মাঝাখানে সেতুর শুরু আবার পানির মাঝখানেই শেষ! খানিক পরে বুঝা গেল, এই সেতুর দুপাশেই রাস্তা আছে যা এখন পানির তলায়। বছরের ৪ মাস এই সেতু পানি তলায়ই থাকে। এরপর এই ভ্রমনে এমন অনেক রাস্তা এবং সেতু আমরা দেখছি। এভাবেই নাকি প্ল্যান করে বানানো এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যাবস্থা। কত অজানারে!

দুপুরে এসে অষ্টগ্রাম পৌঁছালাম। গোসল-খাওয়া পর্ব সেরে যখন বের হলাম তখন সূর্যাস্তের ঘণ্টা দুয়েকের মত বাকি। ফিরে এলাম আবার নদীর পাড়ে। সূর্য কিরণ তখনো নদীর জলে সাতার কাটছে পরমানন্দে। তীরে ভীড়ে রয়েছে বাহারি নৌকা। কেউ আবার সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে নৌকা ভিড়াচ্ছে তীরে। হটাৎ প্ল্যান হল নদীর এই পাড় ধরে শেষ মাথায় যাব। চড়ে বসলাম টমটমে। যেতে যেতে যা দেখলাম তার সারাংশ হল, এ পর্যন্ত যত নদী অঞ্চলে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে তার মধ্যে অষ্টগ্রামের এই নদীর কূল আমার মনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছে। পিচ ঢালা পাড় ধরে যতটুকু গিয়েছি পুরোটাই ছিল বৈচিত্রময়। কোথাও কর্মচঞ্চলতা, কোথাও আলস্য, কোথাও আবার অবকাশের আয়োজন।

Birds in Astagram Kishorganj

নদীর এই পাড় মূলত শক্তিশালী বেড়িবাধ হিসেবেই কাজ করছে বা বানানো হয়েছে। অষ্টগ্রামের সব গুলো রাস্তাই পিচ ঢালা। ঝকঝকে তকতকে! নদীর পাড়ও ব্যাতিক্রম নয়। আমরা যেখানে নামলাম সেখানে পিচ ঢালা একটি রাস্তা আস্তে আস্তে পানিতে নেমে গেছে। এবং ডুবন্ত অবস্থায় কিছুদূর গিয়ে ব্রিজের উপর উঠে আবারো পানিতে নেমে গেছে। কিছুদিন পর এই রাস্তা জেগে উঠবে এবং গাড়ী চলাচল শুরু হবে। কিন্তু সাময়িক এই ডুবন্ত রাস্তাই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। রাস্তার দুপাশে জল থৈ থৈ করছে। দূরে কোথাও থেকে হু হু করে বাতাস এসে গায়ে মাখামাখি করছে। নদীর জলেও তিরতির করে ঢেউ খেলে যাচ্ছে সেই বাতাস। ঐদিকে সূর্যও বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার দ্রুত রং পরিবর্তন আমাদের যেন ফেরার তাড়া দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু নাছোড়বান্দা আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। আর ক্রমেই লাল হয়ে আসা দিগন্তে চেয়ে দেখলাম জলবেষ্টিত এই জনপদে নেমে আসছে নিভৃত এক সন্ধ্যা।

Sunset at Birds Astagram Kishorganj

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share
Tweet
Pin
Share