২০০৮ সাল, মার্চের এক বিকেল বা সন্ধ্যা। ক্যাম্পাসের এক অবসরে বন্ধু প্লাস রুমমেট ব্রুসলি্র (দেশী) সাথে কথা বলছিলাম। পরদিন ছিল শুক্রবার, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ, শনিবারও কিসের যেন বন্ধ। এক কথা, দু কথায় আমরা ভাবলাম কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায় কিনা। বান্দরবান হলে কেমন হয়?
যেই ভাবা সেই কাজ। পরের দিন সকালেই বেরিয়ে পড়লাম। মজার ব্যপার হল, আমরা কেউই এর আগে কখনো বান্দরবানে যাইনি। এমনকি পরিচিত কেউ থাকে বলেও জানি না। তারপরো, রওনা দিলাম। চলতি পথে খোঁজ-খবর করে যতটুকু যাওয়া যায়। আমাদের উদ্দেশ্য কোন পর্যটন স্পট নয়, বরং পাহাড় ও পাহাড়ের জীবনকে কাছ থেকে দেখা।
লং ষ্টোরি শর্ট, পরদিন আমরা যখন বান্দরবান শহরে পৌঁছালাম তখন সূর্য মাথার উপর আসি আসি করছে। ক্ষুধা লেগেছে। পাশেই একটা হোটেলে খেতে বসে গেলাম। খাচ্ছি আর ভাবছি এরপর কোথায় যাওয়া যায়। পাশে এক মধ্য বয়স্ক লোক এসে বসলেন। দেখে এখানকারই বলে মনে হল। জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় গেলে পাহাড় ও পাহাড়ী জীবনকে কাছ থেকে দেখা যাবে। তিনি বললেন, “রুমা”। সাথে এও বললেন, “রুমার গাড়ি নির্দিষ্ট সময় পর আর পাওয়া যায় না।”
এ কথা শুনে আর দেরী করলাম না। ঝটপট বেরিয়ে পড়লাম। ভাগ্য ভাল আমাদের। দিনের শেষ গাড়িটি পেলাম আমরা। এ গাড়ির স্থানীয় নাম, চাদের গাড়ি। কেন এই নামকরণ তা যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরই বুঝতে পারলাম। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। কখনো নামছে তো নামছেই। আবার কখনো উঠছে তো উঠছেই। গাড়ি বোঝাই মানুষ আর মালপত্র। সবাই নির্লিপ্ত। গাড়ির সাথে তাল রেখে হেলছে আর দুলছে শুধু। কিন্তু, নতুন আমি’র অবস্থা অন্য। উঁকিঝুঁকি দিয়ে বাহির দেখার নানান কসরত করে যাচ্ছি। এই করতে করতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে গাড়ি থামলো। এসে গেছি?
না! যাত্রা বিরতি।
গাড়ি থেকে নামলাম। ক্রমাগত ঝাকুনি আর নানামুখি চাপ থেকে মুক্তি পেয়ে শরীরটা একটু আড়মোড়া চাইছে। তা-ই করতে করতে চারপাশটা দেখতে লাগলাম। দুই ভাগে বিভক্ত একটা রাস্তার মোড়ে এসে থেমেছি আমরা। একটা রাস্তা বান্দরবান থেকে এসে দুই দিকে চলে গেছে। এক ভাগ ঢালু হয়ে নেমে রুমার দিকে চলে গেছে। অন্য ভাগ আবার খাড়া হয়ে উঠে থানচির দিকে চলে গেছে। একই পাহাড়ের বিচিত্র কত রূপ।
যাত্রা বিরতি শেষ। এবার আমি গাড়ির ছাদে চড়ে বসলাম। বসেই বুঝলাম চাঁদের গাড়ির ভেতরে বসে পাহাড়ের কত সৌন্দর্য থেকেই না বঞ্চিত হয়েছিলাম। আর উপরেই তুলনামূলক আরাম বোধ হচ্ছিল। রোদ ছিল বটে। কিন্তু বাতাসের ঝাপটা আর মেঘের লুকোচুরি সেই রোদকে ম্লান করে দেয়। দু চোখ দিয়ে জীবনের প্রথমবারের মত পাহাড়ের গহীন রুপে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। উঁচুউঁচু পাহাড়, তার চেয়ে উঁচু সব গাছ! হঠাৎপাহাড় উধাও। তখন আবার গভীর খাদ। খাদে শুধু গাছ আর গাছ। এ যেন সবুজের অন্ধকার।
তবে সবচেয়ে বেশি নজর কাড়ছে “মেঘ”। সাদাকালো মেঘদল ইতিউতি ঘোরাফেরা করছে। কখনো কখনো দমকা হাওয়ায় ভেসে চলে যায় অনেক দূর। আবার কিছুক্ষণ পরেই যেন খেলাচ্ছলে আমাদের পিছু নেয়। কোথাও আবার মেঘদল দূর পাহাড়ের ঢালে আশ্রয় নেয়, জিরিয়ে নেয়। পথের উঁচু পাহাড়ি ঢালগুলো দেখলে মনে হয় যেন শূন্যে গিয়ে মিশেছে। সেই পথ বেয়ে যখন উঠছিলাম তখন মনে হচ্ছিল এই বুঝি মেঘের কাছে গিয়ে ঠেকবো আমরা।
চলতি পথে কোন কোন ঢাল এত উঁচু যে আমাদের গাড়ি এই বোঝাই নিয়ে তা পাড়ি দিতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন উঁকি দেয়। আনন্দ, আগ্রহ, উত্তেজনা ও উৎসাহে ছেদ পড়ল যখন আমরা দেখলাম আমরা একটি নদীর পাড়ে এসে থেমেছি। আমরা কি পৌঁছে গিয়েছি?
না! এখনো পথ বাকি!
আশেপাশে কথা বলে জানতে পারলাম যে, বাকি পথ নৌকায় যেতে হবে। তবে চাইলে হেটেও যাওয়া যায়। তবে তা অনেক দূর। আমরা ঠিক করলাম ফেরার সময় হাটা পথে ফিরবো। সারাদিনের ধকলের পর নৌকাই ভাল চয়েস। জানা গেল, ৪০/৪৫ মিনিট লাগবে এই পথে।
নৌকায় যখন উঠে বসলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার রোদ গায়ে মাখামাখি করছে। নৌকায় যাত্রী আমরা দুজনই । যতদূর মনে পড়ে, নৌকাটি ছিল বৈঠা চালিত। রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য ছাউনিও ছিল তাতে।
নৌকায় চলা শুরু করতেই পা ছড়িয়ে বসে গেলাম। নদীতে স্রোত নেই বললেই চলে। পানিও খুব বেশী নয়। দুপাড়ে নানা রকম ফসলের ক্ষেত। মাঝে মাঝে আদিবাসীদের ঘরবাড়ি দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ নদীতে আসছে গোসল বা পানি নেয়া সহ নানান প্রয়োজনে। অনেকে আবার ছোট ছোট ডিংগি নৌকা নিয়ে বেরিয়েছে মাছের সন্ধানে বা কোনো যাতায়াতে।
সারাদিনের ভ্রমন এবং বয়ে যাওয়া মৃদুমন্দ বাতাসের দরুন শরীরটা আরেকটু আরাম পেতে চাইল। ছাউনির ভেতরে গিয়ে পিঠ টান করে শুয়ে পড়লাম। ফলে আরামই লাগল। নৌকার গতি টের পাওয়া যাচ্ছে। পানি কম হওয়ায় নৌকার তলা নদীর তলদেশের নুড়ি পাথরের সাথে ঘঁষা খাচ্ছে মাঝে মাঝে। সেই ঘর্ষণ নিজের পিঠে টের পাচ্ছি আমি। ধীরে ধীরে ডানে-বায়ে হালকা দুলুনি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। যেন ভাসমান আমিই বয়ে যাচ্ছে নদীর জলে।
নদীপৃষ্ঠ থেকে দুপাশের পাহাড় গুলোকে আরো দানবীয় মনে হচ্ছে। পাহাড়ের ওপারে সূর্য সেই দিনের মত বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের মাঝি অবশ্য জানালো আর বেশী পথ বাকি নেই।
আমরা যখন ঘাটে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা। এখন থাকার বন্দোবস্ত করার পালা। আমরা জানিনা এখানে থাকার কি ব্যবস্থা। কয়েকজন দোকানী হোটেল হিলটনের কথা বললো। এখন আমি ভাবি, সেখানে যদি ঐ একমাত্র হোটেল হিলটন যদি না থাকতো তবে আমরা কোথায় থাকতাম। ব্যবস্থা নিশ্চয় একটা হত। তবে কি ব্যবস্থা হত সেটাই ভাববার মত।
নামে হোটেল হলেও হিলটন আসলে একটি বোর্ডিং। ডাবল বেডের একটি রুমে ১২০ টাকা ভাড়ায় উঠে গেলাম। গোসল করে বের হয়ে পড়লাম আশেপাশে হেটে দেখবো বলে। কিন্তু অন্ধকার হওয়ায় খুব একটা সুবিধা করা গেল না। অগত্যা রাতের খাবার খেয়ে রুমে ফিরে এলাম। কালকের দিনে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে জানিনা। তবে ওসব নিয়ে এখন ভাবলাম না।
এখন শুধু ঘুম দরকার।
গভীর ঘুম!