ভর্তি সংক্রান্ত কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য প্রথম শাটল ট্রেনে উঠি। দশটার ট্রেন ছিল সম্ভবত।খুবই ধীরেগতির ও অনাড়ম্বর একটা যাত্রা ছিল সেটা।
শাটলের স্বমূর্তি আমি দেখি আরো পরে। সেইদিন প্রথম আট’টায় বা সকালের কোন এক ট্রেনে চেপে বসি। ছাত্র-ছাত্রীদের এত ভীড় যে কোন সিট পেলাম না। অনেক ছাত্রকে দেখলাম সিটের উপরে কায়দা করে বসেছে। সিট খালি না পেয়ে আমিও বগির শেষের দিকে একটা সিটের উপর বসলাম।
ট্রেন চলতে শুরু করলো। সেই সাথে আরো একটা ব্যাপার শুরু হল। গান!
কিছু ছাত্র সমস্বরে গাইছে। সদ্য কলেজের গন্ডি পেরিয়ে আসা তরুন-মনে ভালই লাগলো। ট্রেনের গরম, ঘর্মাক্ত পরিবেশ আর বিরক্তিকর লাগছে না। এরপর থেকে আমি কোন বগিতে বেশি ভাল গান গায় তা বের করার চেষ্টা করতাম। তাই একেক দিন একেক বগিতে উঠতাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকি সময়গুলোতেও এই গান উপভোগ করেছি।
এই গান চলে বগির পেছনের দিকে। বগির পেছনে আট-দশ বা যতজন সম্ভব ছাত্র জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে গান করে। গানের মধ্যে বৈচিত্র্য থাকে৷ রক গান, পপ গান, সিনেমার গান, লালন গান, হারানো দিনের গান, এমনকি প্যারোডি গানও বাদ ছিল না। এদের সবাই যে গান জানে তা কিন্তু না। মূলত দুই-তিন জনের গানের গলা থাকে খুব ভাল। তাদের স্রোতেই বাকিরা গলা মিলিয়ে যায়। কত কত ছাত্র যে এই বগিতে এসে গানের লিরিক্স শিখেছে, হারানো দিনের গানগুলোর সাথে পরিচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।
এই গান যখন চলে তখন সেখানে রীতিমতো একটা তান্ডব চলে। সবাই নিজের সর্বোচ্চ স্কেলে গলা ছাড়ে। একজন থাকে ড্রামার। যে কিনা বগির গায়ে চাপড় দিয়ে ক্রমাগত বাজিয়ে যাচ্ছে তাল মিলিয়ে। এ এক অমানুষিক শক্তি ও খাটুনির কাজ। কিন্তু সে থামলে চলবে না। থামলেই বিট মিস! কিন্তু এমনটা কখনো হয় না। শীত, বর্ষা যাই হোক ঐখানে সকলে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়। আপাতদৃষ্টিতে এগুলো ছেলেমানুষী, কিন্তু তা বয়সেরও দাবী বটে।
এ দাবী পথেরও। তা নাহলে ধীরগতির এই শাটলে এই লম্বা পথ পাড়ি দেয়া আরো কঠিন হত। বগির বাকি যাত্রীরা যে যার জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে। কম-বেশি সকলেই শ্রোতা। কেউ চেতনে, কেউ বা অবচেতনে। গায়ক ও শ্রোতারা একই নৌকার মাঝি। শাটলে ওঠার আগেই কেউ হয়তো কোন দুসংবাদ পেয়েছে, কারো পরীক্ষা খারাপ হয়েছে, কারো ফলাফল খারাপ, কারো টিউশনটা চলে গেছে বা মাসের বেতন বাকি, কারো মাথায় মেসের টাকা জোগাড়ের চিন্তা, কেউ দুপুরের মিল দেয়নি, কারো বাড়ি থেকে এখনো টাকা আসেনি ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই গানের মূহুর্তে সেইসব দূর্ভাবনাগুলো জেঁকে বসতে পারে না। গানের পাগলামিতে হারিয়ে গিয়ে সবাই ক্ষণিকের জন্য নিস্তার পেতে চায়৷ আর ঐদিকে একঘেয়ে গতিতে ছন্দমিলিয়ে চলতে থাকে শাটলের বগি গুলো।
শাটলের বগিগুলোর নানা রকম ইন্টারেস্টিং নাম ছিল। যেমন: ককপিট, অলওয়েজ, এপিটাফ, ভিএক্স, ইত্যাদি। এদের মধ্যে “খাইট্টা খা” বগির নামটি আমার ভাল লাগতো। আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা ‘ফাটাফাটি’ নামে একটি বগির নামকরণ করে। এটা নিজেদের হলেও নামটি আমার চলনসই মনে হত না।
আমার দৌড় শাটলের নাম বা গান পর্যন্তই ছিল। বগির পেছনের রাজনীতিতে আমার আগ্রহ ছিল না। যদিও এই শাটলে যে রাজনীতির ছায়া আছে সে কথা আমি জানতে পারি অনেক পরে। এই রাজনীতির ব্ল্যাকহোলে কত মেধাবী ছাত্র যে হারিয়ে গেছে সেই হিসেব কেউ রাখে না।
শুধু রাজনীতি নয়, শাটলে প্রেমও আছে। এখানে প্রেম শুরু হয়, প্রেম ঘটে, এমনকি শেষও হয়। তাহারা শাটলে চেপে আসে, যায়, সঙ্গ দেয়, সময় দেয়।
ছাত্র-ছাত্রীদের সময়ও শাটলকে ঘিরে আবর্তিত হয়। তাদের দৈনন্দিন রুটিন, ইচ্ছা-অনিচ্ছা শাটল নিয়ন্ত্রিত। এক ট্রেন মিস মানে পরের ট্রেন আরো একঘন্টা পর। তাই, দুপুরের খাবার এখন খাবে নাকি পরে, এই ক্লাশ করবে নাকি বাদ দিবে, ক্লাশ শেষে হলে গিয়ে গোসল করবে নাকি করবে না, ঝুপড়ির আড্ডায় থাকবে নাকি বিদায় নিবে, ইত্যাদি সহ সকল যাবতীয় ব্যাক্তিগত ইচ্ছা শাটলের সময়ের শৃংখলে বন্দী।
এই বন্দীদশায় উত্তেজনাও আছে। ট্রেন কি পাওয়া যাবে নাকি ছেড়ে চলে গেছে? ঐতো ট্রেন দেখা যাচ্ছে! ট্রেনে উঠে বসতে পারবে নাকি তার আগেই ছেড়ে দিবে? সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল, ট্রেনের সিট দখল। একজন ছাত্র বা ছাত্রী একাধিক সিট দখল করে রাখে তার বন্ধুদের জন্য। সিট দখলের জন্য ব্যাগ, খাতা, কলম, কাগজের টুকরো এমনকি পাথরও ব্যবহার হয়। অনেকেই সিটে না বসে বা না দাঁড়িয়ে না থেকে সিটের উপরে বসতাম। এতে ভীড় থেকে বাঁচা যায় এবং গানও শোনা যায় ভাল ভাবে।
গান দিয়ে শাটলকাহন শুরু করেছি, গান দিয়েই শেষ করতে চাই। শাটলের একটি চিরসবুজ গান আছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরিদেরই সৃষ্ট। সেই গানের দুটি লাইন:
“বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো যায়-যায় হারিয়ে যায়
উজ্জ্বল ও বর্ণালী দিনগুলো মিলিয়ে যায় হাওয়ায়।”
গানটি গাওয়া হয় সকল গানের শেষে। এই গানের সময় একটা ভিজুয়াল আবহ তৈরী হয়। প্রতিটি দিনই যে অতীতের গহব্বরে মিলিয়ে যাচ্ছে তা মানসপটে ভেসে ওঠে। কেউ কেউ হয়তো ফেলে আসা অতীত বা অনাগত ভবিষ্যতে ডুব দেয়। পাওয়া-না পাওয়া, চাওয়া-না চাওয়াগুলো হাতড়ে বেড়ায় কল্পনায়।
আর, ঐদিকে সুখী বা অসুখী, স্বপনাতুর বা হতাশাগ্রস্থ, নিশ্চিন্ত বা জীবনযুদ্ধরত, সচেতন বা উদাসীন একদঙ্গল ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে নিজের চিরাচরিত দুলকি চালে চলতে থাকে আমাদের শাটল ট্রেন!