বাতাসে টায়ারের পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তার ভাঙ্গা ও অবিন্যস্ত ইটের সাথে গাড়ির টায়ারের প্রবল ঘর্ষনেই যে এর উৎপত্তি সকলেই তা বুঝতে পারলাম। প্রায় ৪৫ ডিগ্রী কোণের একটি কাদামাখা ও এবড়োথেবড়ো ঢাল বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছে আমাদের ল্যান্ডক্রুজারটি।অর্ধেক ওঠার পর আর এগুনো যাচ্ছেনা। ভাঙ্গা কিংবা তেছড়া হয়ে থাকা কোনো ইটের সাথে আটকে আছে গাড়ির চাকা। ড্রাইভার আপ্রান চেষ্টা করে যাচ্ছে সামনে এগুনোর। ইঞ্জিনের তীব্র আর্তনাদ চুরমার করে দিচ্ছে পাহাড়ী নিস্তব্দতা। গাড়িতে আমরা ১১ জন যাত্রী। চেয়ে আছি সামনে, হয়তো শূন্য দৃষ্টিতে। ড্রাইভার যখন ষ্টিয়ারিং নিয়ে ব্যস্ত তখন তার পাশে বসা লাল বম”কে গিয়ার সামলানোর দায়িত্ব দেয়া হল।তিরতির করে কাঁপছে গিয়ার ধরে রাখা তার হাতটি। ঐদিকে লারাম দা’র দৃষ্টি একবার রাস্তার দিকে, আরেকবার ড্রাইভারের দিকে। ঘনঘন পরিবর্তিত হচ্ছে। ড্রাইভারের বাঁ হাতে ষ্টিয়ারিং ধরা। মাথা ও ডান হাত জানালার বাইরে। মনে হচ্ছে সামনের ডান পাশের চাকাটি আটকে গেছে। নানা রকম কসরত করছে ড্রাইভার। হঠাৎ যেন ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। সে সাথে আমাদের দমও! কারন পেছনেই ওৎ পেতে আছে হাজার ফিট গভীর পাহাড়ী ঢাল। একবার ইঞ্জিন বন্ধ হওয়া মানে…, আর ভাবার সাহস হলনা। তবে ড্রাইভারের পারদর্শীতায় হোক আর ভাগ্যের সুপ্রসন্নতায় হোক, হঠাৎ যেন বিদ্রোহী ইঞ্জিন জেগে উঠল। ঝাঁকি দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল গাড়ি। এরপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঢাল বেয়ে উঠে এল। এ যেন মস্ত এক পরিত্রান। শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরটা এলিয়ে দিলামসিটে। “এইটা সেরা!” চিৎকার করে উঠলেন Tapas দা। সামনে বসা লারাম দা’র কন্ঠেও ব্যাপক উল্লাস, “সাব্বাশ বেটা”। আরা এইদিকে আ্মি ভাবছি অন্য কথা। এইরকম আর কয়টি ঢাল পার হতে হবে আমাদের !

সবুজে ঘেরা স্থির, নিশ্চল, সাদা একদলা মেঘ!

যাচ্ছিলাম বগালেক। সকাল ৭ টায় চট্টগ্রাম থেকে রওনা দিয়ে বান্দরবান শহর হয়ে আমরা যখন রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছাই তখন প্রায় বেলা ১ টা। ইতিমধ্যে গাইড লাল বম ও বগালেকে কটেজ মালিক লারাম দা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। এরপর আর্মি ক্যাম্পের ফর্মালিটিস এবং অনুমতি নেয়ার পালা। ব্যাপারটা আধ ঘন্টার হলেও আমাদের সময় লেগেছিল প্রায় তিন ঘন্টা। এবং আমাদের ট্যুরের উত্তেজনার শুরুটা এখান থেকেই। কারন আর্মি ক্যাম্পর পর আবার পুলিশের কাছে নাম এন্ট্রি করার জন্য যেতে হবে ৪ টার মধ্যেই। দেরি হয়ে গেলে বগালেক যাওয়ার অনুমতি মিলবেনা এবং রাত কাটাতে হবে রুমা বাজারে যার মানে হল আমাদের হাতে ৩ দিনের ১ দিন শেষ। অথচ আমরা যখন আর্মি ক্যাম্প থেকে বের হচ্ছি তখন অলরেডি ৪টা পেরিয়ে গেছে। এই সময়ে জীপ পাওয়াও কঠিন। শুরু হল দৌড়। লারাম দা মোটরসাইকেল নিয়ে রওনা দিলেন পুলিশ ফাঁড়িতে যাতে করে নিজের পরিচিতি কাজে লাগিয়ে একটা ব্যাবস্থা করা যায়। কাজ হল অবশেষে। পুলিশের অনুমতি ও জীপ দুটোই মিলল। গাড়ি চলতে শুরু করার পরই আমরা রাস্তার দশা ও আমাদের সম্ভাব্য দূর্দশা সম্পর্কে অনুমান পেলাম। রাস্তার বেশীর ভাগই ইট বিছানো। আর কিছু অংশ পাহাড়ি মাটির। প্রবল বৃষ্টিতে রাস্তায় তৈরি হওয়া খাদে গাড়ির চাকা আটকে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আর যেখানটায় ইট বিছানো সেখানকার অবস্থা আরো করুণ। কাদা ও উঠে যাওয়া ইটের মিশ্রনে গাড়ির চাকা আটকে গেলে রেহাই পাওয়া বেশ কঠিন। আর তা যদি হয় কোনো ঢালু জায়গায় তাহলে বাকিটা ভাগ্যের খেলা বলেই মনে হবে! আমাদের এই রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে বেশ ক’বার। কিছু ঢালের অবস্থা এতই বিপজ্জনক ছিল যে আমাদের সকলকে নামতে হয়েছে।জীপে যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণ পরেই ড্রাইভার ঘোষণা দিল যে, একমাত্র বৃষ্টি ছাড়া সে আর কোন কিছুতেই ভয় পায়না। কারন পাহাড়ে বৃষ্টি যেমন সুন্দর তেমনি ভয়ঙ্কর। ড্রাইভারের কথা শুনে আমরা স্বস্তি ও শক্তি দুটোই পেলাম। কিন্তু একি! বৃষ্টি যে শুরু হয়ে গেল! জানালার বাইরে তাকিয়ে আছি। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল ও আরো বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে। মনে মনে প্রার্থনা করছি এর চেয়ে বেশি জোরে বৃষ্টি যাতে না হয়। কিন্তু তখনও আমরা জানিনা যে আমাদের পুরো ভ্রমনটিই হবে বৃষ্টিস্নাত।

প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমরা জীপ থেকে নামলাম। স্বস্তি পেলাম। যদিও তখনো আমরা বগালেক পৌঁছাইনি। আরও ১১ মাইল বাকি। পুরোটাই হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। বর্ষায় ঐ পথে গাড়ি চলেনা। তবুও গাড়িতে যাওয়ার চেয়ে হেঁটে যাওয়া ভাল, মনে মনে বললাম। গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে যা চোখে পড়ল তা হলো মেঘ! আমরা যে পাহাড় চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছি তারও নিচে! স্থির, নিশ্চল, সাদা একদলা মেঘ। কিন্তু প্রকৃতি রুপ দেখার সময় আমাদের হাতে নেই। গাইড লাল বম আমাদের তাড়া দিল। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। আরো ২/৩ ঘণ্টা হাটতে হবে। প্রায় ছয়টা বাজে। যেতে যেতে অন্ধকার হবে এইটা নিশ্চিত ছিলাম। আচ্ছা যদি সেই সাথে যদি বৃষ্টিও শুরু হয়, তাহলে?

এবং সেটাই হল। হাঁটার শুরুতেই আমরা প্রায় খাড়া একটি ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করলাম। নামছি তো নামছিই। পথের ক্লান্তির কারনেই হোক আর নতুন জায়গার কারনেই হোক, মনে হচ্ছে যেন এই নামা শেষই হবেনা। সম্ভবত ৩০ মিনিট বা এর বেশী সময়ধরে একনাগাড়ে ঢালটি বেয়ে নামলাম। পৌঁছালাম এগারো মাইল বাজার নামক যায়গায়।ততক্ষনে সূর্য ডুবে গেছে। লারাম দা বললেন, ‘আপানারা দ্রুত আগাতে থাকেন। আমি আসতেছি।’। আমরা সামনে এগুতে থাকলাম। ধীরে ধীরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। পাহাড়ি পথ বলে কথা। অন্ধকার দ্রুত আসে। দুপাশে ঘন জংগল। জংগলের ওপাশে নেমে গেছে গভীর খাদ। কোথাও একপাশে জঙ্গল, অন্যপাশে খাদ। খাদের গভীরতা কেমন হতে পারে সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সাহস পেলাম না। অন্ধকারে যখন পথ দেখা যাচ্ছেনা বাধ্য হয়ে অনেকে মোবাইল টর্চ জ্বালালো। পাহাড়ি সরু পথ বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমদের দলটি। হটাৎ কিসের যেন শব্দ। আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকেই। কান পাতলাম আমরা। বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হলনা। সেই শব্দ এসে আমাদের গায়ের উপরেই পড়ল। বৃষ্টি! প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হল। বড় বড় ফোটা। পুরো শরীর ভিজিয়ে দিতে বেশি সময় লাগলো না। কিন্তু আমাদের থেমে থাকার উপায় নেই। রাত বেড়ে চলছে। অনেকের হাতে মোবাইল টর্চ থাকলেও পথ ভাল করে দেখা যায়না। কারন, সরু রাস্তার দরুন পাশাপাশি হাঁটা সম্ভব না। লাইন ধরে হাঁটতে হয়।

স্বাভাবিকভাবেই মোবাইল টর্চের আলোর সুষমবন্টন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে আমার আলোকবর্তিকা ছি্লেন Salam ভাই। অনেকটা আন্দাজ করে পা ফেলে, কিছুটা আলোর সাহায্য নিয়ে আমাদের দলটি এগিয়ে যাচ্ছে। কখনো আবার সামনের জন পেছনের জনকে বিপজ্জনক পথ, সরু রাস্তা, ডানে খাদ, বায়ে গর্ত, বেশী পিচ্ছিল ইত্যাদি বলে সতর্ক করছে। বৃষ্টি যেন থামতেই চাইছেনা। সেই সাথে বজ্রপাতও চলছে। সেই দিকে অবশ্য কারো ভ্রুক্ষেপ নেই আর। পেছনে যাওয়ার যেহেতু উপায় নেই সেহেতু এখন একটাই করনীয়। সাবধানে পা ফেলা ! কখনো ঢাল বেয়ে উঠছি কখনো বা নামছি।বৃষ্টির ছোয়ায় পাহাড় যেন জেগে উঠেছে। লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট পাহাড়ী ঝর্না গুলো সরব হয়েছে। কোনো কোনো ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে সেই ঝর্নার পানি। আমরা সেই গড়িয়ে পড়া পানির অনুকূলে বা প্রতিকূলে হেটে যাচ্ছিলাম। বৃষ্টি থেমে গেল তবে তা বেশীক্ষণ স্থায়ী হল না। আবার শুরু হল। আগের মতই। যাকে বলে প্রবল বর্ষন। এর মাঝেই ছোট ছোট আলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। টর্চের আলোয় সামনের যে পথটুকু দেখা যাচ্ছে আমাদের ভাবনায় তখন ঐটুকুই। কোনো ঢাল বেয়ে যখন সমতল রাস্তা পাই তখন মনে হয় এই পথ যদি শেষ না হত। কিন্তু ঐ দিন বোধ হয় আমাদের আর্জি রক্ষার দিন ছিল না। তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঢাল বেয়ে নামা বা ওঠা শুরু হয়। তেমনি একটি ঢাল বেয়ে সমতলে উঠে এলাম। অনেক্ষন পর সমতল পেয়ে ভালোই লাগছিল। বৃষ্টিও একটু কমেছে। একটু ফুরফুরে লাগছে। পরস্পর একথা-ওকথা বলে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের দলটি। হটাৎ আবার কিসের যেন শব্দ কানে এল। খুব কাছেই মনে হল। সামনেই, কিন্তু দেখা যাছেনা। বৃষ্টিই হবে হয়তো। আবার আসছে। কিন্তু না। শব্দের উৎসের কাছে এসে আমরা যা দেখলাম এর জন্য আমরা, অন্তত আমি, কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের পথের মাঝে বিশাল এক খাদ । আর সেই খাদ বেয়ে প্রচন্ড গতিতে পড়ছে পাহাড়ী ঝর্ণা। আমাদের এই খাদ এবং ঝর্না টপকে যেতে হবে!

আমাদের পুরো দলটি যেন অথই সাগরে পড়ল। প্রচন্ড শব্দে ঝর্নার পানি পড়ছে। রাতের নিস্তব্ধতা যেন সে শব্দকে আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। রাতের আধারেও প্রবল স্রোতে নেমে আসা ঝর্নার সাদা (!) পানি দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে পানির এই তীব্রতায় মাটি ধসে এই খাদ সৃষ্টি হয়েছে। এই বাধা পার হওয়া সম্ভব কিনা তার উত্তর আমাদের জানা ছিলনা। মূহুর্তকয়েক বোধহয় নির্বাক হয়ে দাড়িয়ে ছিলাম । নিস্কৃতির পথ খুঁজছিলাম। পর্যাপ্ত আলোর অভাবে পুরো জায়গা সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যাচ্ছেনা। তাই ব্যক্তিগত ভাবে আমার তৎক্ষনাত ভাবনা ছিল, ঝর্নার তীব্রতা না কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করা। যত সময় লাগবে লাগুক! কিন্তু তখনো বৃষ্টি হচ্ছিল। সুতরাং আমার এই চিন্তা পাগলামী ছাড়া কিছুই নয়। আমার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হল এই বাধা পার হতে পারলে হবে জীবনের এক চরম পাওয়া। খাদটি আমাদের পথটি কেটে আড়াআড়ি ভাবে ঢালু হয়ে নেমে গেছে হাজার ফিট নিচে। সেই ঢালু খাদ দিয়ে প্রচন্ড গতিতে পানি পড়ছে। হঠাৎ দেখি Rizon ভাই এগিয়ে গেলেন। কিভাবে যেন ঐ খাদের পারে চলেও গেলেন! রিজন ভাইয়ের এই সাহসিকতার বিশেষন আমার জানা নাই। ভাল করে খেয়াল করে দেখলাম একটি বাঁশ সাকোর মত করে দেয়া। খাদ পেরুনোর জন্য বৃষ্টিতে ভিজে নড়বড়ে ও পিচ্ছিল হয়ে যাওয়া ঐ বাঁশই একমাত্র অবলম্বন। ব্যপারটা আমার কাছে তখনো অসম্ভব বলে মনে হচ্ছিল। একবার পা পিছলালে পানির প্রচন্ড স্রোতে সব শেষ। একজনের দূর্ঘটনাই পুরো ট্যুরের বারোটা বাজানোর জন্য যথেষ্ট। মাথায় যখন এটা-ওটা ঘুরছিল তখনই এসে হাজির হল আমাদের গাইড লাল বম। সে এসেই খাদের মাঝখানে কায়দা করে দাড়ালো। মূহূর্তেই আমার দূশ্চিন্তা দূর হল। কারন এইসব ব্যাপারে এদের উপর নিশ্চিন্তে ভরসা করা যায়। তার সহযোগিতায় ঐ যাত্রায় পার হয়ে গেলাম।

যাত্রা আবার শুরু হল। বৃষ্টি নেই। কিন্তু রাস্তার অবস্থা যা করার করে দিয়ে গেছে। যে সকল জায়গায় ঘাস সেখানে জোকের সম্ভবনা। যেখানে মাটি ঐখানটায় পিচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমরা এইসব ব্যাপারে একটু ধাতস্থ হয়ে গেছি। আর কতক্ষণ হাটতে হবে? লালকে এই প্রশ্ন ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার করা হয়ে গেছে। এরপর আরও ২ টা গ্রাম এবং এরপরই আমাদের কাংখিত বগালেক। দ্বিতীয় গ্রামটিতে এসে যাত্রা বিরতি করলাম।এরপর থেকেই শুরু বগালেক যাওয়ার মূল পথ। শুনলাম এইখান থেকে বগালেকের চূড়ায় উঠতে সময় নিবে আনুমানিক ৩০-৪০ মিনিট। পুরো সময় জুড়ে খাড়া ঢাল বেয়ে শুধু উঠতে হবে। একটি দোকানে লেবুর শরবত পাওয়া গেলো। খেয়ে নিলাম। বুকে বল নিয়ে (কারন শরীরের বল পাংচার হয়ে গেছে ততক্ষণে :D) শুরু করলাম উঠা। পাহাড়ে যেহেতু এসেছি ঢাল বেয়ে ওঠা-নামা স্বাভাবিক। কিন্তু সময়টি যদি হয় রাত, ঢালটি যদি হয় পিচ্ছিল আর সরু? আমদের দূর্ভাগ্য, সবার কাছে আলো নেই। যাদের কাছে আছে তাও আবার মোবাইল টর্চ। সামনের জনের আলোর উপর নির্ভর করে পেছনের ২/৩ জন চলছে।পাহাড়ী রাতের আঁধারের তুলনায় সেই আলো ছিল অপ্রতুল। অন্তত এই সরু ঢালে। কিছু জায়গা এতই সরু যে, দুই পা পাশাপাশি রাখার আগে মেপে নিতে হবে। এক পাশে পাহাড় হলে, অন্য পাশে খাদ নেমে গেছে। কিছু জায়গা আবার তুলনামূলক প্রশস্থ হলেও সাবধানে পা ফেলতে হবে, কারন বাকি অংশটুকু ভাঙ্গা। সবাই নিজের মত করে উঠছে। বলা ভাল, নিজের শরীর টেনে নিয়ে চলছে। রাস্তা পিচ্ছিল হওয়াতে গ্রীপ করতে সমস্যা হচ্ছে। এখন যদি আবার বৃষ্টি শুরু হয় তাহলে কি হবে তা বলাই বাহুল্য। বৃষ্টি আর আসেনি। ভেবে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হল।

এইদিকে আমার অবস্থাও সংগিন। জুতার তলায় কাদা লেপ্টে আছে। এমনকি পায়ের তলা পর্যন্ত কাদা। এতে করে গ্রীপ করতে বেশি সমস্যা হচ্ছে। বার বার পিছলে যেতে চাইছে পা। বেশ কয়েকবার ঘাস, গাছের পাতা দিয়ে কাদা মোছার চেষ্টা করেছি। লাভ হয়নি, সবই ভেজা। কাধে ব্যাগ,একহাতে লাঠি। অন্য হাত খালি কিন্তু স্যান্ডেল হাতে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। দূর্ঘটনাবশত পড়ে নিতে গেলে কোনো কিছু আঁকড়ে ধরার জন্য একহাত কাজে লাগতে পারে।জানা গেল আর মাত্র ১০/১৫ মিনিট। ওই মূহুর্তে ঐটাও অনেক বেশি মনে হচ্ছিল। দরদর করে ঘামছি। বসে পড়লাম আমি। এসময় এগিয়ে এল “আমার বন্ধু Rashid” । ব্যাগটি তার নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। আমিও অবশেষে স্যান্ডেল হাতে নিয়ে নিলাম। বেশীক্ষন বসে থাকা যাবেনা। কারন পেছনে যারা আছে তারা যেতে পারছেনা। অগত্যা উঠে পড়লাম। পথ আর বেশী বাকি নেই, এই ভরসায় চলতে শুরু করলাম। হঠাৎ সামনের কয়েক জনের চিৎকার কানে এল। আতংকের নয়, উল্লাসের। এসে গেছি বগালেক!

রাত তখন নয়টা ।

Facebook Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share
Tweet
Pin
Share